সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ ভাদ্র ১৪৩১

মঞ্চসারথি আতাউর রহমান

হীরেন পন্ডিত
  ০১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মঞ্চসারথি আতাউর রহমান

বাংলাদেশের যে ক'জন মানুষ নাট্যাঙ্গনকে বিকশিত করেছেন তাদের অন্যতম মঞ্চসারথি আতাউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে নাট্যচর্চাকে শানিত করে চলেছেন নিরলসভাবে। দেশের অন্যতম নাট্য নির্দেশক, নাট্য সমালোচক, অভিনেতা, কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগঠকও তিনি। মঞ্চসারথি আতাউর রহমান ১৯৪১ সালে ১৮ জুন নোয়াখালীতে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলজীবনেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পা রাখেন আতাউর রহমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নটীর পূজা' নাটক দেখে তার মঞ্চপাঠ শুরু। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ২১ ফেব্রম্নয়ারি উপলক্ষে শহীদুলস্নাহ হল থেকে আব্দুলস্নাহ আল মামুনসহ তিনি প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন আতাউর রহমান। ১৯৭২ সালে 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এর মাধ্যমে তার নাট্য নির্দেশনা শুরু। এরপর তিনি নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের লেখা 'বাকি ইতিহাস'। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শন শুরু হয়। এরপর নিজের দলে ও অন্য দলের হয়ে অসংখ্য নাটকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

মঞ্চ নাটকের নির্দেশনার পাশাপাশি আতাউর রহমান অভিনয়ও করছেন সমানতালে। রেডিও, টেলিভিশনেও রয়েছে তার সরব উপস্থিতি। এছাড়া নাট্য বিষয়ক বই, নাট্যসমালোচনা, উপস্থাপনা, শিক্ষকতা, টেলিভিশন নাট্যকার, প্রবন্ধকার, বক্তা সবক্ষেত্রেই রয়েছে আতাউর রহমানের সরব পদচারণা। ২০০১ সালে নাট্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য একুশে পদক পান আতাউর রহমান। বিনোদনের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের ও সমাজের নানা বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়। দর্শক তা মঞ্চে খুঁজে পান। আগের চেয়ে এখন মঞ্চের অবস্থা অনেক ভালো। নতুন নতুন নাটক ও নতুন দল আসছে এটা খুবই আশাপ্রদ। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটক নিয়ে কাজ করলেও লেখালেখিতেও অভ্যস্ত তিনি। এ পর্যন্ত তার ১৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশি নাটকের অনুবাদ করেছেন ১০টি নাটক।

তার ভাষায় আমার জীবন ধন্য করেছে আমার প্রিয় মাতৃভূমি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের শুভক্ষণে এবং আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বর্ষের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকন্যা, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে ধন্য করেছেন। উলেস্নখ্য ২০২১ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে সংস্কৃতিকর্মী, নাট্যজন ও নাট্যকর্মীদের ইতিহাস। স্বাধিকারের নানা পর্যায়ে তাদের ভূমিকা অনন্য। একেবারে শূন্য থেকে বাংলাদেশের নাটক এখন বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে গত ৫৩ বছরে। তিনি মনে করেন, নাটক শুধু বিনোদন নয়, গণশিক্ষার মাধ্যম। নাটকের ভেতর দিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী, মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন করেছি। নাটক সমাজের দর্পণ। যখন একটা ভালো নাটক দেখি, ভেতরে কোথায় যেন একটা টঙ্কার ওঠে। শিল্প কখনো কলকবজা খুলে বোঝা যায় না। এ আপনাকে আভাস-ইঙ্গিত দেয় শুধু। এই ইঙ্গিতটাই শিল্প। অভিনয়ের সময় মঞ্চে এমন কিছু মুহূর্ত তৈরি হয়, তখন মনে হয় এ জন্যই বেঁচে ছিলাম, আমি যেন স্বর্গকে স্পর্শ করছি। যদি এর পরমুহূর্তে মারাও যাই, কিছুই আসবে-যাবে না।

নবজাগরণ ঘুরে ঘুরে আসে। ঈশ্বরচন্দ্র্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমের সময় রেনেসাঁস স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় নবজাগরণ এলো। আমাদের দেশে ত্রিশ বছর পর হয়তো স্তিমিত হতে পারে। তারপর আবার নবজাগরণ আসবে নতুন প্রজন্মের হাতে। নাটককে পেশাদারি অর্জন করতেই হবে। আমরা সেদিকটায় ধাবিত হচ্ছি। সরকারও ভাবছে নাটকের মানুষের ভাতা দেওয়া যায় কিনা! এক সময় ছিল কাজের পাশাপাশি থিয়েটার করেছে নাট্যকর্মীরা। তবে এখনো মনে হয় জীবিকার মাধ্যম যদি টেলিভিশন হতে পারে তাহলে থিয়েটার হবে না কেন! মানুষ তো একই সঙ্গে দু-তিনটি পেশার সঙ্গে জড়িত থাকেন। অনেকে আছেন সারাদিন চাকরি করে সন্ধ্যায় অন্য কাজ করছেন। ভালোবাসার সঙ্গে পেশা মিলিয়ে ফেললেই সমস্যা। এটা শুধু করপোরেট দুনিয়ায় সম্ভব।

\হস্বাধীনতাপরবর্তী ৩০-৩৫ বছর নাট্যচর্চা তুঙ্গে উঠেছিল। কলকাতার লোকজন আমাদের নাটক দেখে ঈর্ষান্বিত হতো। ৫৩ বছর আগে লাখো প্রাণের বিনিময়ে এই দেশে একটি বিস্ময়কর ও গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা ঘটেছিল। পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্ব-মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের আত্মপ্রকাশ- যার নাম বাংলাদেশ। পেছনে ফিরে এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি, আসলে এটা স্বপ্ন ছিল না সত্যিই ঘটেছিল? আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যতটুকু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ও তার পরবর্তী স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দ এবং দুখঃ-কষ্টের প্রতিফলন থাকার কথা ছিল ঠিক ততটা পড়েনি।

তবে এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে ভিত্তি করে বেশ কিছু ভালো উপন্যাস, কবিতা, ভাস্কর্য, ছোটগল্প, অঙ্কন শিল্প এবং নাটক রচিত হয়েছে। প্রয়োগশিল্প মাধ্যমগুলো, যেমন থিয়েটার, যাত্রা, নৃত্যশিল্প, পুতুল নাচসহ অন্যান্য লোকজ অভিনয়, নৃত্য ও সঙ্গীত প্রধান মাধ্যমগুলোতে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিভাস পরিলক্ষিত হয়। থিয়েটার বা মঞ্চনাটককে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ফসল। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশেই দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার সূচনা হয়- যা আজ একটি ব্যাপক ও দর্শক-প্রিয় শিল্পমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। নাট্যকলা বিষয় হিসেবে দেশের চারটি প্রধান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এছাড়া কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নাট্যকলা শিক্ষা-সূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নাট্যকলা শেখানের জন্য দেশে কয়েকটি প্রাইভেট স্কুল নিয়মিতভাবে সক্রিয় রয়েছে। যথেষ্ট না হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নাটকের মঞ্চ গড়ে উঠেছে। মঞ্চনাটক ভিত্তিক একাধিক সাময়িকী বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলো মঞ্চনাটককে গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন ও খবরা-খবর পরিবেশন করে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটি বিশেষ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশ গ্রম্নপ থিয়েটার ফেডারেশন দেশের নাটকের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উলেস্নখযোগ্য প্রতিষ্ঠান। আজ যারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অভিনয়ের ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে তাদের অনেকেই মঞ্চনাটকের অভিযাত্রী। টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তায় এবং অংশগ্রহণেও মঞ্চনাটকের কর্মীরা বর্তমানে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের প্রধান নাট্যকারদের লেখায় আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে যথেষ্ট পরিমাণে। আমরা প্রায়ই বলি, ১৯৫৬ সালে ভাঙা ক্যামেরা দিয়ে সত্যজিৎ রায় 'পথের পাঁচালী, অপুর সংসার, অপরাজিতা' করেছিলেন সেটাকে আজ পর্যন্ত কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। যে কাজ করছে সে মানুষটি সবচেয়ে বড়। টেকনোলজির দরকার আছে, কিন্তু টেকনোলজি সবচেয়ে বড় নয়। সেটা মনে রেখে মানুষ তৈরি করতে হবে। স্কুল-কলেজে বেশি তাদের শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি কবিতা পড়াতে হবে। এবং তাদের শিল্পমনস্ক করে গড়ে তুলতে হবে। সবার মাঝে দেশপ্রেমকে যদি উজ্জীবিত করা যায় তাহলে শিল্প সংস্কৃতি এমনিই চলবে। আমাদের কবিতা-সাহিত্য এগিয়ে চলবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংকের মধ্যে বসে একজন লিখছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গগ না খেয়েই প্রায় মারা যান। জীবনানন্দ দাশ ট্রামের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে না খেয়ে মারা গেছেন। দুঃখ বেদনা থেকে কবিতার জন্ম।

বিশ্বকর্মাকে পাঠাল ব্রহ্মা, তুমি এই নবরত্ন ছন্দ দিয়ে কী করবে? বলে আমি তো জানি না। বলে, রামের জীবনী লিখব। রাম সম্পর্কে ও জানে না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তুমি রচিবে যাহা তাহাই সত্য বটে কবির কলমে। দুঃখ ও বেদনা ছাড়া শিল্প সৃজন হয় না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে