উত্তম কুমারের দুই শ্রেষ্ঠ নায়িকা সুচিত্রা সেন ও সুপ্রিয়া দেবী। সময়ের বিবেচনায় সমসাময়িক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রী। রুপালি পর্দায় দুজনের দাপটে আজও মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক। বাঙালির চিরকালের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু দুই নায়িকা। মহানায়িকা খেতাবে সুচিত্রার পালস্না ভারী হলেও সুপ্রিয়াভক্তরা সুপ্রিয়াকেও মহানায়িকা মানেন। উত্তম-সুচিত্রা না উত্তম-সুপ্রিয়া, কোন জুটি বেশি রোম্যান্টিক- এই নিয়ে আজও বাঙালির গোলটেবিল বৈঠকের শেষ নেই। উত্তম কুমারের সঙ্গে পর্দায় সবচেয়ে বেশি যিনি উপস্থিত- তিনি হলেন সুচিত্রা সেন। আর সুপ্রিয়া? তার নামেই তো লুকিয়ে আছে তার মহিমা। শুভ যে প্রিয়া। অর্থাৎ উত্তমের শুভ লক্ষণযুক্ত প্রিয়া। যিনি উত্তমের ভালোবাসা। সমাজ তাকে হাজার অসম্মান দিলেও উত্তমকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সুপ্রিয়া তার অপরিসীম সেবা দিয়ে। যা সুচিত্রা সেন-সুপ্রিয়া দেবীর একসঙ্গে ছবি কত খুঁজেছে, কত দেখতে চেয়েছে বাঙালি, কিন্তু কোনো দিন তেমন ছবি তোলেননি দুই নায়িকা। এমনকি একসঙ্গে কখনো ফিল্মও করেননি দুজনে। উত্তম-সুপ্রিয়া ছবির প্রিমিয়ারে গেলেও হাজির হননি সুচিত্রা সেন। কিন্তু সুচিত্রা-সুপ্রিয়ার দুই নাতনি ভীষণ বন্ধু- যা হয়তো মানুষ জানে না। লোকচক্ষুর আড়ালেই দুই নাতনি মিলে কলকাতার আনাচে-কানাচে কাটিয়ে আসছেন কোয়ালিটি টাইম। মানুষ কত আর খোঁজ রাখত উত্তম কুমারের প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর কথা। ফিল্মি পার্টিতেও গৌরী দেবী খুব একটা যেতেন না।
বাংলা ছবির দর্শকের কাছে সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই শুরু হয়ে যায় সুচিত্রা সেনকে উত্তম কুমারের বউ ভাবা। উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রতিটি ছবির শেষে তাই আলিঙ্গন-দৃশ্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু বাস্তবে সুচিত্রা সেন সে অর্থে চাননি বিবাহিত উত্তমকে কখনো মনের মানুষ করতে। অন্যদিকে, বিধ্বস্ত উত্তম কুমারকে এক সময় নিজের ফ্ল্যাটে আশ্রয় ও আস্থা দিয়েছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন সিঙ্গল মাদার হয়ে সুপ্রিয়ার এই কঠিন সিদ্ধান্তে সমাজ সংসার নড়ে উঠেছিল। সুচিত্রা সেন এসেই উত্তমকে পর্দায় হিট করান, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনে বিধ্বস্ত উত্তমের ভরসার জায়গা হয়েছিলেন সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়া সে সময় ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার ছবি করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। আম্রপালীতে তার সাহসী অভিনয় দেখে মুগ্ধ দর্শক। তার ঘরেতেই একদিন ফিল্মের অফার নিয়ে এলেন স্বয়ং উত্তম কুমার।
সুচিত্রা-উত্তম জনপ্রিয় জুটির মধ্যে এসে দাঁড়ালেন সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়া বুঝলেন সুচিত্রা সেনের ঢলঢল দুর্নিবার গস্ন্যামারের কাছে তিনি হারিয়ে যাবেন। তাই হলিউড স্টাইলে সাহসী সাজপোশাকে নিজের ভোল বদলে ফেললেন সুপ্রিয়া। শুরু হলো নতুন জুটি উত্তম-সুপ্রিয়া। একটা সময়ের পর তো সুপ্রিয়া উত্তম ছাড়া অন্য নায়কদের সঙ্গে ছবি করাও ছেড়ে দিলেন। শুধু উত্তম-সুপ্রিয়া তিনি। এটাও কি কম ত্যাগ ঋত্বিক ঘটকের নায়িকার! সুপ্রিয়া কখনো চাননি সুচিত্রার মতো উত্তমের আগে তার নিজের নাম ছবির টাইটেল কার্ডে রাখতে। সুচিত্রা সেন-সুপ্রিয়া দেবী কি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী সত্যি ছিলেন? সাপে-নেউলে কি ছিল তাদের সম্পর্ক! সুচিত্রা সেন মুখে কুলুপ আঁটলেও সুপ্রিয়া বলেছিলেন, আমার চেষ্টা ছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটির মধ্যে ঢোকার। সে স্বপ্ন সত্যি করেছিলাম। কিন্তু আমি নিজেও উত্তম-সুচিত্রার ফ্যান। ওদের ছবি সিনেমাহলে গিয়ে দেখতাম। ওদের জড়াজড়ি দেখেও মুগ্ধ হতাম।
বাঙালিদের চিরকালের আক্ষেপ ছিল সুচিত্রা সেন-সুপ্রিয়া দেবীর একসঙ্গে ছবি দেখার। সেটা আর হলো না। আবেগ ভালোবাসা যেমন সুচিত্রা সেনের মধ্যে ছিল, একইভাবে ছিল সুপ্রিয়া দেবীর মধ্যেও। তবে সুপিয়া দেবীর হৃদয় বেশি কোমল উদার আর সংবেদনশীল ছিল উত্তমের জন্য। তাই উত্তমের শেষ জীবনে তিনিই ছিলেন ভরসা। যা সুচিত্রার পক্ষে সম্ভব হয়নি।