নন্দিত-নিন্দিত সুপ্রিয়া দেবী

১৯৬৩ সালের পৌষ মাসে শালগ্রাম শিলাকে সাক্ষী রেখে উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবীর বিয়ে হয়। পৌষ মাসে বিয়ে হয় না, কিন্তু ওদের হয়েছিল। সুপ্রিয়ার বাবা গোপাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রিয়ার বড় জামাইবাবু বনফুল, সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সুপ্রিয়াকে সিঁদুর পরিয়ে ছোট গিন্নির সম্মান দেন উত্তম

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঙালি সমাজে পরচর্চার কেন্দ্রবিন্দু সুপ্রিয়া দেবী বহুদিন ধরেই। সুপ্রিয়া কারও সংসার ভাঙেননি। যতই মধ্যবিত্ত মানসিকতার মহিলারা সে কথা বলুন না কেন, আসলে উত্তমই এসেছিলেন সুপ্রিয়ার কাছে। সে রাতটা ছিল ১৯৬৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন উত্তমের প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর জন্মদিন। ভবানীপুরের বাড়িতে আনন্দ-উৎসব হচ্ছিল। হঠাৎ অশান্তির ঝড় উঠল। সন্দেহপ্রবণ গৌরীর কুকথা সহ্যের সীমা ছাড়াল উত্তমের। তখনই এক জামাকাপড়ে রাত সাড়ে দশটা-এগারোটায় উত্তম বেরিয়ে গেলেন বাড়ি ছেড়ে, গাড়ি নিয়ে। সেদিন সারারাত পথেই কেটেছিল তার। সে রাতই মহানায়কের জীবনে নতুন অঙ্কের সূচনাপট। উত্তম পরে লিখেছেন, 'দর্শক, প্রযোজক, পরিবেশক মহল আমার কাছে অনেক প্রত্যাশা করেন। তাই প্রথমেই আমি চাইলাম মানসিক প্রশান্তি। যা পেলে আমি কাজ করতে পারি। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে হাজির হয়েছিলাম ময়রা স্ট্রিটে। বেণুকে বলেছিলাম, তুমি ময়রা স্ট্রিটে ফ্ল্যাট নেওয়ার পর থেকে অনেক দিন আমাকে আসতে বলেছিলে। আজ এসেছি, তুমি আমাকে আশ্রয় দেবে? তৎক্ষণাৎ মহিলা একা হয়েও বেণু বিস্ময় ও মমতা দুই নিয়ে হাসি মুখে দরজা খুলে আমায় আশ্রয় দিয়েছিল। সেই থেকে ময়রা স্ট্রিটে আমি সতেরোটি বছর। যা ছিল তখন আমার মানসিক শান্তির তুলনাহীন তীর্থ। তবে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি মা, গৌরীর সঙ্গেও।' ১৯৬৩ সালের পৌষ মাসে শালগ্রাম শিলাকে সাক্ষী রেখে উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবীর বিয়ে হয়। পৌষ মাসে বিয়ে হয় না, কিন্তু ওদের হয়েছিল। সুপ্রিয়ার বাবা গোপাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রিয়ার বড় জামাইবাবু বনফুল, সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সুপ্রিয়াকে সিঁদুর পরিয়ে ছোট গিন্নির সম্মান দেন উত্তম। তবে সুপ্রিয়া কখনওই গৌরী দেবীর সংসার দখল করার বা অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি করেননি। বরং অসুস্থ গৌরী দেবীকে রান্না করে পাঠাতেন সুপ্রিয়াই। কিন্তু আবেগ ও স্নেহের বশে সুপ্রিয়া যে ভুল করেছিলেন, সুচিত্রা সেন কিন্তু সেই ভুল করেননি। হয়তো তাই সুচিত্রা 'দেবী' হয়ে রয়ে গেলেন জনমানসে, আর সুপ্রিয়া 'দেবী' হয়েও তা রইলেন না। সুচিত্রা উত্তমকে ফিরিয়ে দিলেও, সুপ্রিয়া কিন্তু তার কেরিয়ারের পূর্ণ বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময়টা দিয়ে দিলেন উত্তম কুমারকে। উত্তমকে আশ্রয় দিয়ে তার জীবনে হয়ে উঠলেন উত্তমময়ী। আবেগের তোড়ে ভেসে গেলেন সুপ্রিয়া। তার নিজের আমিত্ব হারালেন, উত্তুঙ্গ ফিল্মি কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিলেন। সঙ্গে সমাজের চোখে রক্ষিতা ও সঙ্গিনী হয়ে উঠলেন। যে বেণু 'মেঘে ঢাকা তারা'র নীতা করেছেন, 'কোমল গান্ধার' করেছেন, 'স্বরলিপি', 'স্বয়ম্বরা' করেছেন, কিশোর কুমার ও ধর্মেন্দ্রর নায়িকা, সাহসী আম্রপালী করে ঝড় তুলেছেন, তিনি কেন উত্তমমাটির উপর নিজের জীবন দাঁড় করালেন! যেসব ছবিতে সুপ্রিয়া নায়িকা নন, উত্তমের সেসব ছবির আউটডোরেও তিনি যেতেন, ভালো ভালো রান্না করতেন ও সবাইকে খাওয়াতেন। উত্তমের জন্য রাঁধতেন হালকা, সুস্বাদু রান্না। হয়তো কিছুটা উত্তমের ওপর নিজের অধিকার বজায় রাখতেও যেতেন। সুপ্রিয়া সেই সমাজে আরও এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটান। তার প্রথম স্বামী বিশ্বনাথ চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ের পর দিলিস্ন থেকে কলকাতা কাজে এসে, একবার এলেন বেণুর কাছে। বললেন, হোটেল পাননি। সুপ্রিয়া বলেছিলেন 'কোথায় যাবে আমার ফ্ল্যাটেই থাকো। সোমা খুশি হবে।' তখন উত্তম প্রয়াত। কিন্তু তবু সমাজ যেন ভাবতেই পারে না এ উদারতা। যদিও সে সাময়িক, তখন যে নতুন করে বিশ্বনাথবাবুর প্রতি সুপ্রিয়ার কোনো অনুভূতি জন্মেছিল তা একেবারেই নয়। শ্রী তারাশংকর 'আম্রপালী' করার সময়ে যাকে ছাড়া তার নায়িকা ভাবতে পারেননি, তিনি সুপ্রিয়া। তিনি ডাকনামে বেণু। তিনি শ্রী তারাশংকরকে বলেছিলেন 'আমি আম্রপালী'র চরিত্র করতে কোনোরকমের পোশাক পরব।' সেদিন সাহসিনী সুপ্রিয়ার সেই কথা শুনে সবাই বলেছিলেন 'তাহলে সিনেমা হলে ঢিল পড়বে। অমন দুঃসাহস দেখিও না বেণু।' বেণুর জবাব ছিল, 'তাহলে এই চরিত্র নিয়ে ছবি করবেন ভেবেছেন কেন? যদি সাহসী পোশাক পরাতেই না পারেন!' শেষ অবধি 'আম্রপালী'তে কাঁচুলি পরিহিতা সুপ্রিয়া রুপালি পর্দার সামনে আসেন। বেণু বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে যৌনতাকে পৌঁছে দেন সৃজনশীলতার সঙ্গে। এক ছবিতেই বেণু আম্রপালী রূপে সব পত্রিকার হেডলাইন হয়ে যান। সুচিত্রা, সাবিত্রী, অরুন্ধত... এসব প্রতিমা মুখ নায়িকাদের জামানায় এক আগুন সুপ্রিয়া জ্বলে ওঠেন। তার মুখে বিখ্যাত ডায়লগ 'দাদা আমি বাঁচতে চাই'। সত্যিই ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন থেকেই তার একার লড়াই শুরু। বাঙালির প্রাণপ্রিয় উত্তম কুমারকে সুপ্রিয়া যে উজাড় করা ভালোবাসা দিয়েছিলেন, সেটাই কিন্তু মহানায়ককে বাঁচিয়ে রেখেছিল। যখন তিনি মহানায়ক, তখন সুপ্রিয়া তার ছায়াসঙ্গিনী ছিলেন। নারীকেন্দ্রিক সিনেমা 'মেঘে ঢাকা' তারাই বাংলা ছবিতে প্রথম। তার আগে রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে হলেও নারীকে ভেবে চিত্রনাট্য এই প্রথম- যা লিখলেন ঋত্বিক ঘটক- শুধু সুপ্রিয়ার জন্য। ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি ভোরে এসব থেকে চিরনিষ্কৃতি পেলেন সুপ্রিয়া। জীবনভর কর্তব্যের পাট চুকিয়ে দিলেন। আর কেউ বলার রইল না, 'আপনাদের দাদা এইটা খেতে ভালোবাসত', 'আপনাদের দাদা ওইটা পরতে ভালোবাসত'। প্রাণের মানুষের সঙ্গে আবার দেখা হলো বেণুর। সুপ্রিয়ার প্রয়াণে উত্তম যুগ শেষ হওয়ার মতোই শেষ হলো দেবী যুগও। কানন দেবী, ছায়া দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, অরুন্ধতী দেবীদের উত্তরসূরি ছিলেন একমাত্র সুপ্রিয়া দেবী। সেই সুপ্রিয়া দেবীই শেষ দেবী হয়ে চলে গেলেন। দেবী যুগ শেষ হয়ে গেল চিরতরে। এখনকার কোনো নায়িকার আর দেবীতে উত্তরণ ঘটেনি। সুচিত্রাকে উত্তমের শ্রেষ্ঠ জুটি ভাবা হলেও, সুচিত্রা উত্তমকে কতটা ধারণ করতেন তা জানা নেই। কিন্তু সুপ্রিয়া দেবী এই তিন দশকের বেশি সব লেখায়, সব ইন্টারভিউতে উত্তম কুমারের কথা বলেছেন। সুপ্রিয়া নিজে যত না নিয়েছেন তার চেয়ে ঢেড় লোককে দিয়ে গেছেন। আরও এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ ঘটেছিল সুপ্রিয়া মৃতু্যতে, সুচিত্রা ও সুপ্রিয়ার কন্যা দুই বোন হয়ে উঠল। মুনমুন সোমাকে দিলেন বড়দির মতো ভরসা। তাই সুপ্রিয়া প্রস্থানে আজ আর কোনো রাগ নয়, শুধু অনুরাগ। মধুময় হোক বেণুদির আগামী জন্ম ও জীবন। ভালোবাসা ভরা থাক, নিন্দায় নয় ভালোবাসায়।