মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

একুশে পদকের গৌরব ডলি জহুর

গতবার পুরস্কৃত হয়েছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননায়। আর এবার পেলেন একুশে পদক- যা বাংলাদেশের একটি জাতীয় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। পুরস্কার সম্পর্কে এতক্ষণ যার কথা বলা হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের অভিনয় জগতের এমন একজন গুণী অভিনয় শিল্পী- যার তুলনা তিনি নিজেই। ছোটপর্দায় তো বটেই- চলচ্চিত্রেও। এ দেশের চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে যে কয়জন শিল্পীর নাম প্রথম সারিতে থাকবে তার অন্যতম হয়ে থাকবেন ডলি জহুর
মাতিয়ার রাফায়েল
  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
একুশে পদকের গৌরব ডলি জহুর

গতবার পুরস্কৃত হয়েছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননায়। আর এবার পেলেন একুশে পদক- যা বাংলাদেশের একটি জাতীয় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। পুরস্কার সম্পর্কে এতক্ষণ যার কথা বলা হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের অভিনয় জগতের এমন একজন গুণী অভিনয় শিল্পী- যার তুলনা তিনি নিজেই। ছোটপর্দায় তো বটেই- চলচ্চিত্রেও। এ দেশের চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে যে কয়জন শিল্পীর নাম প্রথম সারিতে থাকবে তার অন্যতম হয়ে থাকবেন ডলি জহুর। সেই আনোয়ারা, শামীমা আক্তার রোজী, আফরোজা সুলতানা রত্না (শাবানা)- চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে যাদের নাম প্রথমেই আসে তাদের মধ্যে ডলি জহুরও তার আপন স্বাতন্ত্র্য নিয়েই থাকবেন।

তারই স্বীকৃতি এবার মিলেছে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। ১৩ ফেব্রম্নয়ারি এ ঘোষণাটি আসে। রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হলেও নিঃসন্দেহে এটা তার ক্যারিয়ারের জন্য হবে সর্বোচ্চ পুরস্কার- যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রবর্তন করা হয়।

অতঃপর সেই পুরস্কার ২০ ফেব্রম্নয়ারি মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে অভিনেত্রী ডলি জহুরসহ ২১ বিশিষ্টজনের হাতে 'একুশে পদক-২০২৪' তুলে দেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই বেসামরিক পুরস্কার প্রদান করেন তিনি।

এর আগে তিনি পেয়েছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির জুরি বোর্ড কর্তৃক আজীবন সম্মাননা। অবশ্য তখন তার এই পুরস্কার পাওয়ার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম জল ঘোলা করা হয়নি। বিতর্ক হয়েছিল অনেক। ফেসবুকে এ নিয়ে অনেকেই অনেক কটাক্ষাসহ বিরূপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ডলি জহুর এ নিয়ে কোনো দুঃখ বা খেদ প্রকাশ করেননি। বরং বলেছেন, একটি দেশের সবারই যার যার অবস্থান থেকে যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। তবে বিষয়টি তখন এ অভিনেত্রী ডলি জহুরকে আহতও করেছিল। আজ তার এই পুরস্কার নিঃসন্দেহে সেইসব অনুদারদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই যথেষ্ঠ।

আর যা-ই হোক, একজন চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে বাংলাদেশের অভিনয়ের জগতে ডলি জহুর যে মাত্রার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সেটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না; এমন কোনো দর্শক নেই যার অভিনয় দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তেন না। এ দিক থেকে তিনি কিংবদন্তির পর্যায়েই চলে গিয়েছিলেন।

এর মধ্যে এমন সুখবরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অভিনেত্রী ডলি জহুর বলেন, 'রাষ্ট্রীয় এই পদক পাওয়া অবশ্যই আনন্দের। তবে আমি শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ। আমার করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। যখন পুরস্কারের খবরটি ঘোষণা করা হয় তখন আমি নিয়মিত চেকআপের জন্য হাসপাতালে। খবরটা পাওয়ার পর আমার খুব ভালো লাগছে। এত বড় একটা প্রাপ্তি যে, শুনেই বুক ভরে গেল। পুরস্কারটি ঘোষণার কয়েকদিন আগে অনেকেই বলাবলি করছিল, আমার নাকি একুশে পদক পাওয়া উচিত। আমি তখন তাদের বলেছি, 'এসব পুরস্কারের প্রতি আমার কোনো লোভ লালসা নেই'। তবে যখন সত্যি সত্যি পুরস্কারের কথা শুনি, তখন খুবই অবাক হয়েছি।'

থামলেন না আবেগাপস্নুত কিংবদন্তি। বললেন, 'তবে আমি সব সময়ই বলতাম এবং আজও বলছি, আমার চেয়ে দেশে আরও অনেক গুণী মানুষ আছেন। তাদেরও এই সম্মাননা পাওয়া উচিত।'

ডলি জহুর আরও বলেন, 'জীবদ্দশায় একুশে পদক পাওয়াটাই বড় বিষয়। কারণ, অনেকেই তো মরণোত্তর পুরস্কার পান। আমি মনে করি, যাদেরই সম্মান জানানো হোক, সেটা তাকে বেঁচে থাকতেই জানানো উচিত।'

একুশে পদক পাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা খুব আনন্দিত জানিয়ে অভিনেত্রী বলেন, 'আমার ছেলে হুবহু তার বাবার মতো হয়েছে। কোনো কিছুতেই খুব একটা বেশি উচ্ছ্বাস দেখায় না। তবে আমার একুশে পদক প্রাপ্তির খবরে ভীষণ খুশি হয়েছে সে। আমার ছেলের বউ বিদেশ থেকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আমার ভাগনি তার অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছে। সে-ও আমার মেয়ের মতো। তার উচ্ছ্বাস ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া অভিনয় শিল্পীরা যেভাবে আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, আমি খুশি। এটাই ভালো লাগা। এটাই জীবনের আনন্দ।'

আজীবন সম্মাননা ও একুশে পদক পাওয়ার পর জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে এ বরেণ্য অভিনেত্রী বলেন, 'আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই। আমি আমার জীবন নিয়ে খুশি। কখনোই আমার বেশি চাওয়া ছিল না। সব সময় অল্পতেই খুশি থেকেছি। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৫০ পেলেও খুশি থাকতাম আমি।'

ডলি জহুর আরও বলেন, 'সব সময় আলস্নাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আলস্নাহ যেন সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন। খুব বেশি আর চাওয়া নেই। অভিনয় করে কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া। একজীবনে বহু নাটক-সিনেমায় নানারকম চরিত্রে অভিনয় করে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। তাই এখন আর অভিনয় নিয়েও বেশি চাওয়া নেই। যতদিন বেঁচে আছি, অভিনয় করে যেতে চাই। সুস্থতার জন্য সবার দোয়া চাই। '

ডলি জহুর অভিনয়ে যেমন সেইসঙ্গে চমৎকার বন্ধুসুলভ একজন মানুষও তিনি। বিনয় তার চরিত্রের ভূষণ। সেটা আরও একবার বোঝা গেল তার এই পুরস্কারপ্রাপ্তি প্রতিক্রিয়ায়।

এই বিনয়ের কারণেই হয়ত বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও একপর্যায়ে অভিনয়ের জগৎ থেকে হঠাৎই অন্তর্ধান ঘটে যায় তার। যেখানে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন কোনো দর্শক চাহিদা না থাকলেও একমাত্র অভিনয়কে ভালোবেসেই এ জগৎকে আঁকড়ে থাকেন, সেখানে দর্শক বা নির্মাতাদের কাছে বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও অভিনয়ের জগৎ থেকে নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়েছিলেন। আড়াল হয়ে গিয়েছিলেন মঞ্চ, ছোট-বড় পর্দার সব জায়গা থেকে।

মঞ্চ থেকে শুরু করে ছোটপর্দা ও বড়পর্দা সব মাধ্যমেই ডলি জহুরের সমান পারদর্শিতা ছিল তাকিয়ে থাকার মতো। নব্বইয়ের দশকের সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের মায়ের চরিত্রে তার তুলনা তিনিই ছিলেন। কিংবা ভাবি বা বড় বোনের চরিত্রে। যার হাসিটিও যেন একজন অকৃত্রিম দরদমাখানো বাঙালি মায়ের হাসির মতোই। দুঃখ, বেদনা, উদ্বেগ, কষ্টেও তার মুখটি যেমন মলিন হয়ে ওঠতো সেখানেও থাকত অবিকল বাঙালি মায়েরই ছাপ। চলচ্চিত্র কিংবা নাটকে মা হিসেবে সাবলীল অভিনয় দিয়ে অসংখ্য দর্শকদের হৃদয় জয় করেছেন তিনি।

এ দেশের অভিনয়ের জগতে মা, ভাবি, বড় বোনের চরিত্রে তার মতো মানানসই অভিনেত্রী হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বিই তিনি। এ পর্যন্ত ১৬০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। ডলি জহুরের ছোটপর্দায় যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। ১৯৮৫ সালে বিখ্যাত এই লেখক ও সাহিত্যিকের 'এইসব দিনরাত্রি' নাটকটিতে নিলু ভাবি চরিত্রে দারুণ পরিচিতি লাভ করেন। ছোটপর্দায় পদার্পণের দুই বছর আগে চলচ্চিত্রে যোগ দেন। কাজ করেছেন দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রে। দুই বার জিতেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। একবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে, আরেকবার পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে। ১৯৯২ সালে মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত 'শঙ্খনীল কারাগার' ছবিটিতে অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম জাতীয় পুরস্কারটি লাভ করেন। এরপর ২০০৬ সালে কাজী মোরশেদের 'ঘানি'তে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জিতে নেন দ্বিতীয় জাতীয় পুরস্কারটি। জুরি বোর্ডের হিংসা হতো কিনা কে জানে নয়ত এই পুরস্কার তার অভিনয় প্রতিভার তুলনায় কমই। তবে এই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে পাওয়া পুরস্কারগুলোও চলতি বছরের ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মিউজিয়ামের জন্য দান করে দিয়েছেন এই গুণী অভিনেত্রী।

উচ্চশিক্ষিত ডলি জহুর পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৭৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কথক নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে মঞ্চ নাটক দিয়ে অভিনয় যাত্রা শুরু হয় তার। চলচ্চিত্রে ২০১৫ সালে 'শেষের রাত্রি' সিনেমায় তাকে শেষবার দেখা যায়। এই সিনেমাটি যেন তার অভিনয় জীবনেরও শেষের রাত্রি হয়ে গেল। এমনকি এরপর শ্যাম বানেগাল পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক সিনেমাতেও ডাক এসেছিল তার। এ ডাকেও তিনি সাড়া দিতে পারলেন না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে