আজও লীলা লাস্যময় শর্মিলা
'কাশ্মীর কি কলি'খ্যাত ভারতীয় সিনেমার একজন কিংবদন্তি অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার' নামের সিনেমায় প্রথম অভিষেক হয় তার। ছিলেন কলকাতা ইন্ডাস্ট্রির সোনালি যুগের বাংলা সিনেমার নায়িকা। পরে পাড়ি জমান বলিউডে। সেখানেও সমান প্রতাপের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন
প্রকাশ | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
'কাশ্মীর কি কলি'খ্যাত ভারতীয় সিনেমার একজন কিংবদন্তি অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। ছিলেন কলকাতার ইন্ডাস্ট্রির সোনালি যুগের বাংলা সিনেমার নায়িকা। পরে পাড়ি জমান বলিউডে। সেখানেও সমান প্রতাপের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন। কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার' নামের সিনেমায় প্রথম অভিষেক হয় তার। সিনেমাটি ছিল প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। তার আরেক উপন্যাস 'পথের পাঁচালি', যা ছিল সত্যজিৎ রায়েরও প্রথম সিনেমা। যে সিনেমার মধ্য দিয়ে সত্যজিৎ রায় বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইতিহাস হয়ে আছেন সেটারই সিকু্যয়েল ছিল 'অপুর সংসার' সিনেমা।
প্রথম সিনেমাতেই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন শর্মিলা ঠাকুর দর্শকদের মনে। ভারতের ক্লাসিক সিনেমার একটি 'অপুর সংসার'। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণের অমর সৃষ্টি। 'পথের পাঁচালি' উপন্যাসেরই মুদ্রার অপর পিঠ। এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি- যেখানে অপর্ণার বর মানসিক ভারসাম্যহীন। বিয়েটা ভেঙে যায় অপর্ণার। কিন্তু সেই সময়ে সামাজিক প্রথা এমনই ছিল যে, বিয়ের আসর থেকে বরপক্ষ উঠে গেলেও ভালো চোখে দেখা হতো না। এমন পরিস্থিতিতে অনুরোধে পড়ে তরুণ অপু অপর্ণাকে বিয়ে করে। এই অপু চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন টালিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুরু হয় তাদের ছোট্ট সংসার। সব মিলিয়ে পর্দায় তাদের মিনিট বিশেক দেখা যায়। আর পর্দায় ২০ মিনিটে অপর্ণা আর অপুর যে অসাধারণ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, এখনো সেটি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে তাদের কথা ঘুরেফিরে আসে। দর্শকদের মনে স্থায়ী হয়েছে আজও সেই সংলাপ, 'যে টিউশনিটা আছে, সেটাও ছেড়ে দাও, তারপর আমার গরিব বর সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসবে আর আমার কোনো অনুশোচনা থাকবে না।'
সেই সংলাপ, আঙ্গিক, বাচিক অভিনয়, সেই চোখ কি ভোলার মতো? ১৪ বছরের কিশোরী 'অপর্ণা'র সুনিপুণ অভিনয় কখনোই ভুলতে পারবে না দর্শক। দর্শকের মনে আজও টাটকা সিগারেটের প্যাকেটে সেই লেখা, 'খাবার পরে, একটা করে কথা দিয়েছ।'
তখন ছিল সাদা কালোর যুগ। সাদা কালো পর্দায় ক্লাসিক সিনেমা যেন আরও বেশি মূর্তমান ও ক্লাসিক হয়ে ওঠে। আজকের যুগের দর্শকদের কাছে হয়ত তিনি নায়ক সাইফ আলি খানের মা, নায়িকা কারিনা কাপুরের শাশুড়ি আর তৈমুরের দাদি কিন্তু এক সময় ভারত, এমনকি বাংলাদেশের দর্শকের কাছেও ছিলেন তিনি স্বপ্নের নায়িকা!
তবে আজকে বর্ষীয়ান হলেও এখনো তার চেহারায় যে উজ্জ্বলতার ছাপ রয়ে গেছে সে জন্যই নামের পাশে বরাবর বসে আছে 'চিরসবুজ' তকমাও। পর্দায় তার সুমিষ্ট হাসি আর হরিণী চোখের চাহনি আজও তাকে আকর্ষণীয় করে তোলে সবার কাছে।
জীবনের প্রথম সিনেমাটিই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছিল। পাশাপাশি 'অপর্ণা' ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এরপর শর্মিলা একে একে অভিনয় করেন সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী', 'নায়ক', 'অরণ্যের দিনরাত্রি', 'সীমাবদ্ধ' ছাড়া আরও অনেক বাংলা ছবিতে।
এরপর টালিউডের সীমানা পেরিয়ে ১৯৬৪ সালে ২০ বছর বয়সে পাড়ি জমান আরব সাগরের তীরে। হিন্দি সিনেমার কেন্দ্রভূমি বোম্বাইতে। ওই বছরই শক্তি সামন্ত পরিচালিত 'কাশ্মীর কি কলি' ছবি দিয়ে শুরু হয় শর্মিলার মুম্বাই অভিযান। প্রথম ছবিতেই তার অনবদ্য অভিনয় নজর কাড়ে গোটা উপমহাদেশে। একের পর এক মুক্তি পায় 'ওয়াক্ত', 'অনুপমা', 'দেবর', 'শাওয়ান কি ঘাটা' নামে বাণিজ্যসফল সিনেমা।
শর্মিলা ঠাকুর ছিলেন এমন একজন অভিনেত্রী যিনি নিজেকে ভাঙতে ভালোবাসতেন। চরিত্রের বৈচিত্র্য ছিল তার আরাধনার বিষয়। প্রতিবারই পর্দায় তাকে ভিন্নভাবে খুঁজে পাওয়া যেত। ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'নায়ক' সিনেমায় উত্তম কুমারের বিপরীতে একেবারেই আলাদাভাবে দেখা গেছে শর্মিলাকে। সাংবাদিকের চরিত্রায়নে আবারও অসাধারণ অভিনয়শৈলীর প্রমাণ দেন তিনি। নিজেকে ভাঙতে ভালোবাসতেন শর্মিলা।
দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জনকারী এই অভিনেত্রী সম্প্রতি দ্বাবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে ১০ দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। উৎসবে এশিয়ান প্রতিযোগিতা বিভাগে ছবিগুলো দেখে সেরা সিনেমা বাছাইয়ে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই সফরে তিনি পুনঃনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাতে অংশগ্রহণ করেন। ওপার বাংলার অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর বেশ ভালোই বাংলা বলতে পারেন। তবে ঢাকা এসেই বাংলা বলতে আপত্তি জানান তিনি। কথা বলেছেন ইংরেজিতে। অনুরোধের পরও তিনি বাংলায় কথা বলেননি। বাংলায় কথা না বলার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'এখানে বাংলা কেন বলতে যাব! সবাই তো জানে যে আমি বাংলা বলতে পারি। কী? আপনারা জানেন না? আমি তো বাংলা বলি সবসময়। কিন্তু, এটা তো একটা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। অনেক বিদেশি মানুষ আছেন। সুতরাং, আমার মনে হয়, ইংরেজিটা একদম ঠিক হবে।'
শর্মিলা ঠাকুর ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম অভিনেত্রী যিনি গস্নামারকে আবেদনময়ী করে তুলেছিলেন। শাড়ি ছেড়ে বিকিনি পরে তাক লাগানো যৌনাবেদন ছড়িয়েছিলেন দর্শকের মনে। বর্ষীয়ান হলেও আজও চালচলনে পুরাদস্তুর স্টাইলিশ তিনি। ১৯৬৭ সালে শক্তি সামন্তের 'অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস' সিনেমায় বিকিনি পরে তার পর্দায় আবির্ভাব রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয় গোটা ভারতে। রক্ষণশীল মানুষ তীব্র সমালোচনা করলেও, লাস্যভঙ্গিমায় তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। সে বছরই ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও এই একই বেশে দেখা যায় তাকে। সে সময় আলোচিত এক ফটোশুটে দেখা যায়, বিকিনি পরে নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে স্কি করছেন শর্মিলা ঠাকুর। হিন্দি সিনেমায় তিনিই প্রথম যিনি প্রচলিত সামাজিক প্রথাকে উপেক্ষা করে বিকিনি পরে রুপালি পর্দায় ভেসে ওঠেন।
শর্মিলা ঠাকুরের নামটি উচ্চারিত হলেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটিও অবলীলায় চলে আসে। কবির 'ঠাকুর' পদবিটা নিয়ে শর্মিলাও গর্বিত। এমন একজন বিশ্বকবির নামের পদবির সঙ্গে তার নামের পদবি, ভাবতেই তার বুক গর্বে ফুলে উঠত। শর্মিলা ঠাকুরের ভাষায়, 'এমন একই পরিবারে জন্মগ্রহণ করাটাও আমার জন্য অনেক সম্মানের। আমার জন্মের বছর তিনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। তাই তার সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ না হলেও, মায়ের মুখে তার অনেক গল্প শুনেছি।'
শুধু তাই নয়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শর্মিলার মানসের ওপর কী যে প্রভাব ফেলেছিল সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলা সিনেমা 'দেবী'তে। বলেন, 'আমার ছবি 'দেবী' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় তৈরি। মূল বিষয় একই।' প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'দেবী' ছবিতেও রবীন্দ্রনাথের গল্পে ও সাহিত্যে যেভাবে নারী চরিত্রগুলো ফুটে ওঠে সেসব নারী চরিত্রের সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া যায়। গত বছর হিন্দি ওয়েব ফিল্ম 'গুলমোহর' মুক্তি পায়। এ ফিল্মে অভিনয় করেছেন শর্মিলা।
ব্যক্তিগতভাবে শর্মিলা ঠাকুর বিখ্যাত ক্রিকেটার নবাব পরিবারের সদস্য মনসুর আলি খান পাতৌদির স্ত্রী। তার ছেলে সাইফ আলি খান একজন হিন্দি চলচ্চিত্রের সফল অভিনেতা এবং তার মেয়ে সোহা আলি খান হিন্দি চলচ্চিত্রের একজন অভিনেত্রী। শর্মিলা ঠাকুর ২০০৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের প্রধান ছিলেন। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৯ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জুরি সদস্যদের একজন ছিলেন। ২০১৩ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত করে।