বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তুমুল জনপ্রিয় এক নাম আসাদুজ্জামান নূর। পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে। কবিতাও দারুণ আবৃত্তি করেন। বিটিভির সবচেয়ে আলোচিত ধারাবাহিক হুমায়ূনের 'কোথাও কেউ নেই' এর 'বাকের ভাই'খ্যাত এই অভিনেতা তার অসাধারণ অভিনয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে যতটা আলোড়িত করতে পেরেছেন তার আগে ও পরে কখনোই দেখা যায়নি। সেটারই প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনে পাঁচ-পাঁচ বার সংসদ সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে। যা দিনে-রাতে চব্বিশ ঘণ্টা রাজনীতিতে সময় ব্যয় করা রাজনীতিকের পক্ষেও সম্ভব হয় না সেটা তিনি এক ওই 'বাকের ভাই' খ্যাতি থেকে শুরু করে 'মির্জা সাহেব' বা 'ছোট মির্জা' চরিত্রের মধ্য দিয়ে গোটা বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই নিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
এখন এমন হয়েছে, এই প্রথিতযশা অভিনয় শিল্পীর পরিচয় নতুন করে দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতি করা এই তুখোড় রাজনীতিবিদ যে শুধু অভিনয়েই ঝানু পেস্নয়ার এমন নয়, সেটা তিনি তার অভিনয়ের মাঝ বয়সে পুনরায় রাজনীতিতে এসেই দেখিয়ে দিলেন এবং পরপর পাঁচবার বিজয়ের বরমাল্য গলায় ঝোলালেন। একজন অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এই যে কীর্তি গড়লেন মনে হয় না ভবিষ্যতে আর কোনো অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এমন সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবেন। শুধু সংসদ সদস্যই নয়, একবার তিনি সরকারের পূর্ণ মন্ত্রীর পদও অলঙ্কৃত করেছেন।
১৯৭২ সালে একজন সাধারণ থিয়েটারকর্মী হিসেবে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন নূর। পরবর্তীকালে সেই সাধারণ থেকে হয়ে ওঠেন অসাধারণ অভিনেতা। ছোটপর্দায় অভিনয় শিল্পের জাদুকর। যার জাদুকরী অভিনয় দেশের দর্শককে কোনো না কোনোভাবে সম্মোহিত করেছে। অভিনয়ে এমন উজ্জ্বল ও বহুমাত্রিক দ্বিতীয়টি কাউকে দেখা যায়নি। যে অভিনয় শিল্পীর তৃপ্তিকর জায়গা মূলত দুটি। একটি অভিনেতা হিসেবে আরেকটি রাজনীতিক হিসেবে। এরকম সাফল্য খুব কম অভিনয় শিল্পীর ভাগ্যেই জোটে। পেশাগতভাবে সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু করা আসাদুজ্জামান নূর দেশ টিভির 'কে হতে চায় কোটিপতি'র সঞ্চালক হিসেবেও দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। 'বেলা অবেলা সারাবেলা'র সঞ্চালক হিসেবেও কুড়িয়েছেন প্রশংসা। ছিলেন ১৯৭২ সালে চিত্রালীর সাংবাদিক। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাসের প্রেস রিলেশন অফিসার হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৮০ সালে ইস্ট এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডে সাধারণ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব সামলান। ২০১৮ সালে লাভ করেছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। পেয়েছেন অনেক গৌরবজনক পুরস্কার। প্রগতিশীল চিন্তা ও বাঙালি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী এ অভিনেতা ২০০৮ সালের দিকে বেসরকারি টেলিভিশন দেশ টিভিতে প্রথমে এমডি পরে ২০২২ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন।
অভিনয় জীবনে দিয়েছেন দুটি নাটকের নির্দেশনা, যেখানে 'দেওয়ান গাজীর কিসসা' তিন শতাধিকবার মঞ্চস্থ হয়। নির্মাণ করেছেন ৫০টিরও বেশি বিজ্ঞাপনচিত্র ও ভিডিও ছবি।
অভিনয়ে সব সময়েই অতি নাটকীয়তা থেকে দূরে থেকেছেন। যার অভিনয় একেবারেই সাধারণ, স্বাভাবিক ও আটপৌঢ়ে। বিটিভির সবচেয়ে আলোচিত ধারাবাহিক হুমায়ূনের 'কোথাও কেউ নেই'। 'বাকের ভাই' চরিত্রে যে অভিনয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। চরিত্রটিতে দর্শক এতটাই সম্মোহিত হয়ে পড়েন, 'বাকেরের ফাঁসি হবে' এমন একটি শুটের আগে প্রেস ক্লাবে পর্যন্ত সমাবেশ ডেকে প্রতিবাদ সভা হয়। তার অভিনয়কে দর্শক স্বীকৃতি দেন রাজপথে নেমে। দেয় তাকে কিংবদন্তির মর্যাদা। মঞ্চেও অনেক দর্শকনন্দিত কাজ করেছেন।
উলেস্নখযোগ্য কাজ এসব দিনরাত্রি, অয়োময়, আজ রবিবার ও সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড তার জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক। চলচ্চিত্র শঙ্খনীল কারাগার, দহন, চন্দ্রকথা ও আগুনের পরশমণি। সামনে দেখা যাবে শিকলবাহা, গাঙচিল ও প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর উপন্যাস অবলম্বনে 'মেঘমলস্নার'খ্যাত জাহিদুর রহিম অঞ্জনের 'চাঁদের অমাবশ্যা' চলচ্চিত্রে।
সর্বশেষ অভিনীত তার এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে তারার মেলা'কে বলেন, 'আমি ছবিটিতে কাদেরের বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। খুবই ধার্মিক, গ্রামে ফিরে এসেছেন। ওইখানে তার ছোট ভাই কাদের এবং তাদের বাড়িতে যে মাদ্রাসার শিক্ষক থাকতেন- এই তিনটি চরিত্র নিয়েই গল্পটি। ছোট ভাইটাকে বড় ভাই মনে করে খুবই ধার্মিক ও স্পিরিচু্যয়াল মানুষ, যে একজন নারীকে খুন করে; যেটা ওই মাদ্রাসার শিক্ষক দেখে ফেলে। গল্পের তিনটি চরিত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ।'
এ বহুমাত্রিক অভিনেতা অভিনয়ে যে উচ্চতায় উঠেছেন উলেস্নখযোগ্য কাজগুলোতেই ছিলেন লেখক ও নির্দেশক হুমায়ূন আহমেদ, ছিলেন আরও দর্শকপ্রিয় সহশিল্পী, কারিগরি সহযোগিতায় ছিলেন ক্যামেরাম্যান, সংলাপ, চিত্রনাট্য- সব মিলিয়েই এমন একটা টিম যেখান থেকে আরও অনেকেই পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়েছেন- এমন একটি টিম ওয়ার্কের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বরেণ্য এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, 'অবশ্যই, অবশ্যই। এখানে একা একা কাজ করা যায় না। এজন্য ভালো একটা টিম ওয়ার্ক লাগে। ভালো লেখা, ভালো নির্দেশক থেকে শুরু করে ভালো জিওসি ক্যামেরাম্যানও লাগে। ট্যাকনিক্যাল সব সহযোগিতা লাগে। সবাই সমান ভালো না হলে একটা না একটা খুঁত থেকেই যায়।' এখনকার নাটকে সে রকম টিম ওয়ার্কের অভাববোধ করেন কিনা, এমন কথায় তিনি আরও বলেন, 'এখন যারা কাজ করেন তারা তো খুব একটা নির্দেশনা দেন না। আমরা যারা- অন্তত, আমি নিজের কথা বলতে পারি, আমি নির্দেশকের ওপর খুবই নির্ভরশীল একজন অভিনেতা। আমি নিজের ভুলত্রম্নটিগুলো বুঝতে পারি না। আমাকে সেগুলো ধরিয়ে দিলে আমার জন্য সুবিধা হয়। এখন যেহেতু আমি অনেক সিনিয়র হয়ে গেছি তাই এখনকার নির্দেশকরা মনে করে আমার ভুলত্রম্নটিগুলো কী করে ধরিয়ে দেবে। তখন এ নিয়ে তারা একটা অস্বস্তিতে থাকে। তাতে করে আমারই ক্ষতি হয়ে যায়।' কিন্তু আপনি তো এক জায়গায় এমনও বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদ লেখক হিসেবে অনেক বড় মাপের কিন্তু নির্দেশক হিসেবে ততটা বড় মাপের নয়- এমন প্রসঙ্গে ফিরে গেলে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, 'আমি আসলে বলতে চেয়েছি, যেমন 'আগুনের পরশমনি' সিনেমাটিতে তার চমৎকার নির্দেশনা আছে। সব নির্দেশকের সব ছবিই সমানভাবে ভালো হয় না। সত্যাজিৎ রায় সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে- তাই না! পৃথিবীর যেসব বিখ্যাত ডিরেক্টর আছেন তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারেও এই একই কথা প্রযোজ্য। তাদের কোনো ছবি যেমন আইকনিক হয়েছে, কোনোটা হয়তো ওই পর্যায়ে যেতে পারেনি। সুতারাং, তাতে একটা ওঠানামা থাকেই।'
এটাও তো বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদ এবং আসাদুজ্জামান নূর, দুজনই দুজনের পরিপূরক- হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও নির্দেশনা থাকাতেই তার পক্ষে যেমন অনেক জনপ্রিয় পারফর্ম করা সম্ভব হয়েছে আবার সে পারফর্মের গুণে হুমায়ূন আহমেদের কাজগুলোও জনপ্রিয় হওয়ায় সহজ হয়েছে। সেখানে অন্য অভিনয় শিল্পী থাকলে হয়তো এতটা জনপ্রিয় হতো না। এই প্রতিবেদকের এমন পর্যবেক্ষণে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, 'এ কথা ঠিক, হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ লেখা না হলে আমরা কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারতাম না। কারণ লেখাটাই হলো মূল ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনটা ভালো না হলে অন্য কাজগুলোও ভালো করা সম্ভব নয়। আর আমার দিক থেকে আমি কখনো একই ধরনের চরিত্রের অভিনয়ে আগ্রহী ছিলাম না। আমি নানান ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে আগ্রহী। সে কারণে অনেক ভেরিয়েশন এনেছি আমার অভিনয়ে। এ না হলে একই ধরনের অভিনয় তো একঘেয়েও হয়ে যায়।'
আসাদুজ্জামান নূর পাঁচ বারের জনপ্রতিনিধি। মন্ত্রিত্বও লাভ করেছেন- যা এ দেশের শোবিজে কারও জীবনেই ঘটেনি- এ জন্য তাকে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় অভিনয় থেকে দূরে থাকতে হয়েছে- এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, 'সেটা তো আছেই। এ নিয়ে আমার একটা আক্ষেপ আছে। আবার নেই-ও। কারণ জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেশ ও আমার নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে যে কাজ করেছি সেটাও আমার তৃপ্তিকর জায়গা। আমি খুব বেশি কিছু হারিয়েছি এটাও মনে করি না।'
আরও কি এমন কাজ আছে- যা অসমাপ্ত রয়ে গেছে- এমন কথায় এ অভিনেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নূর বলেন, 'আমি রাজনীতিতে আছি, রাজনীতি করছি। এখানে আমাদের নেত্রী আছেন আমাদের দলের সভাপতি। আগামীকাল আমরা কে কোথায় থাকব তাও জানি না। তবে আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি।'
সর্বশেষ তার নতুন সিনেমা 'জয় বাংলার ধ্বনি' সিনেমাতে কাজ করার কথা ছিল। চরিত্রটি ছিল একজন রাজাকারের। কিন্তু পরে এটা ছেড়ে দেন। তার আগে এ সিনেমা ছাড়েন চুক্তিবদ্ধ হওয়া আরেক অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামাল।