শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

এবার মাঠের নায়ক ফেরদৌস

দুই বাংলার জনপ্রিয় নায়ক ফেরদৌস আহমেদের জন্ম কুমিলস্নার তিতাস উপজেলায়। বেড়ে উঠেছেন ঢাকা সেনানিবাস এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এ সময় থেকেইর্ যাম্প মডেল হিসেবে পদচারণা করে খ্যাতি পেয়ে যান। এরপর পা রাখেন রুপালি পর্দার জগতে। ১৯৯৭ সালে ছটকু আহমেদের 'বুকের ভিতরে আগুন' দিয়ে। ২৬ বছর আগে ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম মেগা হিট সিনেমা 'হঠাৎ বৃষ্টি' এখনো মানুষের মুখে মুখে। দুই বাংলা থেকে নির্মিত তার সেই প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা দিয়েই করেছিলেন বাজিমাত। সেই সিনেমা থেকেই হয়ে গেলেন দুই বাংলার প্রথম সফল নায়ক। আর এবার প্রথমবারের মতো নামলেন জাতীয় নির্বাচনী মাঠে। এখানেও ঘটালেন সেই 'হঠাৎ বৃষ্টি'র মতো প্রথমেই বাজিমাত। হয়ে গেলেন রুপালি পর্দা থেকে মাঠেরও নায়ক। তাকে নিয়ে আজকের তারার মেলার আয়োজন। লিখেছেন মাতিয়ার রাফায়েল।
মাতিয়ার রাফায়েল
  ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
এবার মাঠের নায়ক ফেরদৌস

দৈনিক যায়যায়দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গক্রমে দুই বাংলার সফল নায়ক ফেরদৌস আহমেদ বলেছিলেন, 'পর্দার নায়ক থেকে আমি মাঠের নায়ক হতে চাই।' কথাটি তিনি বলেছিলেন বছরখানেক আগে। নায়ক ফারুকের মৃতু্যতে তার ঢাকা-১৭ আসন শূন্য হয়ে পড়ায় সে উপনির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ত ভাবছিলেন অন্য কথা। তিনি ফারুকের শূন্য আসনে মনোনীত হলেন না। যে ফেরদৌস আহমেদ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম দুই বাংলার সফল নায়ক হতে পেরেছেন; তিনি কেন তার অগ্রজ প্রজন্মের আরেক নায়কের শূন্যস্থানে বসতে যাবেন?

এ যেন ফেরদৌসের নায়কোচিত খ্যাতির সঙ্গে ঠিক মানানসই হয় না। কে জানে, হয়ত তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবছিলেন, নায়ক আকবর হোসেন পাঠান দুলু ফারুককে যেমন বাংলাদেশের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন আসন ঢাকা-১৭ তথা গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মতো অভিজাত এলাকার জন্য মনোনীত করে সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী করে এনেছিলেন; তেমনি নায়ক ফেরদৌস আহমেদের জন্যও বাংলাদেশের আরেক মর্যাদাসম্পন্ন আসন ঢাকা-১০ তথা ধানমন্ডি-নিউমার্কেট-কলাবাগানের মতো অভিজাত এলাকায় মনোনয়ন দিয়ে তাকে বিজয়ী করে আনবেন।

না, ফেরদৌস আহমেদ কোনো উপনির্বাচন থেকে নয়, সরাসরি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেই নায়ক ফারুকের পর দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে সাংসদ হয়ে তারকাতের মান রেখেছেন। তবে এখানে নায়ক ফারুকের চেয়ে নায়ক ফেরদৌসের জয় আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম যিনি নায়ক থাকা অবস্থাতেই 'মাঠের নায়ক' হতে পেরেছেন। এই সৌভাগ্য ইতোপূর্বে ঢাকাই তারকাদের মধ্যে আর কারোরই হয়নি।

একদিকে, অভিনয়ে নিজের তারকা ইমেজ তো আছেই- অন্যদিকে, শোবিজ তারকাদের নিয়ে যেরকম সচরাচর নানা স্ক্যান্ডেল থাকে সেই ছাপ থেকেও মুক্ত থাকা নিয়ে নায়ক ফেরদৌসকে ঘিরে অবশ্য আগে থেকেই চিত্র তারকাদের মধ্যে এমন একটা আশাবাদ কাজ করছিল। এবারের নির্বাচনে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রথমবারের মতো নায়ক থাকা অবস্থায় একজন নায়ক সংসদ সদস্য হতে যাচ্ছেন। চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ তারকাদের সেই মান রেখেছেন।

চূড়ান্তভাবে ফলাফল আসার পরে যখন জানা গেল, ঢাকা-১০ আসনে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন ফেরদৌস আর ওই সময় থেকেই একে একে তাকে ফুল দিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে থাকেন ঢাকাই তারকারা। দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হন ফেরদৌস।

'মাঠের নায়ক' হওয়ার স্বপ্ন দেখার শুরু ফেরদৌস আহমেদের অবশ্য এই আজকের নয়। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৩ সদর আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য সর্বপ্রথম স্বপ্ন দেখেন নায়ক ফেরদৌস। যশোর সদরের ঘোপে ফেরদৌসের শ্বশুরবাড়ি। তার স্ত্রী তানিয়া ফেরদৌসের বাবা মরহুম আলী রেজা রাজু ছিলেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। তিনি সাংসদও ছিলেন ওই আসনের। তার পরিবর্তেই ফেরদৌস আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সফরে সঙ্গী হয়ে আমেরিকায়ও গিয়েছিলেন। সেখানে সরকারি অতিথি হিসেবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ওই সফরকে কেন্দ্র করেই পরে ছড়িয়ে পড়েছিল ফেরদৌস নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। ফেরদৌসের শ্বশুর আলী রেজা রাজু ছিলেন যশোর-৩ আসনের সাংসদ। ২০১৬ সালে তিনি মারা যান। এরপর ২০১৮ সালে শ্বশুরের আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটা আগ্রহের প্রকাশ ঘটে নায়ক ফেরদৌসের মনে।

তবে সেবার নায়ক ফেরদৌস আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। তিনি যদি বলেন, তখনই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করব।'

এবারও যখন যায়যায়দিন থেকে ফেরদৌস আহমেদকে প্রশ্ন করা হয়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি থাকছেন কিনা, তখন সেই একই কথা বলে বলেছিলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রীর লোক। তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করেন। এখন তিনি যদি চান আমি নির্বাচন করি তাহলেই দেখা যেতে পারে।'

এরপর তাকে যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, নিজের জন্মভিটা কুমিলস্নার তিতাস উপজেলায় যাওয়া আসা করেন কিনা। এলাকাবাসীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন কিনা এবং নিজের এলাকা থেকে নির্বাচন করার ইচ্ছে আছে কিনা।

ফেরদৌস আহমেদ বলেন, 'গ্রামের বাড়িতে আমার মাঝেমধ্যে যাওয়া হয়। তবে সেটা ওখান থেকে নির্বাচন করার উদ্দেশ্যে নয়। গ্রামের বাড়িতে আমার আব্বার প্রতিষ্ঠিত একটি হাইস্কুল আছে। আমি সেই স্কুলের সভাপতি। সেজন্য আমাকে অন্তত প্রতি বছর সেখানে যেতে হয়। নির্বাচন নিয়ে আমার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন, আমি দেশের যে কোনো জায়গা থেকে নির্বাচন করব। এটা পুরোপুরি তারই সিদ্ধান্ত। আমি আসলে নির্দিষ্ট কোনো এলাকার বাসিন্দা নই, আমি ফেরদৌস সারাদেশের মানুষের।'

এতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছাতেই ফেরদৌস আহমেদ ঢাকার সবচেয়ে দামি আসনটিতে মনোনীত হন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি যেমন ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তেমনি তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নও পূরণ করতে সক্ষম হলেন।

দুই বাংলার জনপ্রিয় নায়ক ফেরদৌসের জন্ম কুমিলস্নার তিতাশ উপজেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় মডেলিংয়ে নাম লেখান। এরপর চলচ্চিত্রে। ২৬ বছর আগে মুক্তি পাওয়া প্রথম মেগা হিট সিনেমা 'হঠাৎ বৃষ্টি'র এখনো মানুষের মুখে মুখে। ফেরদৌস বেড়ে উঠেছেন ঢাকা সেনানিবাস এলাকায়। সেজন্যও হয়ত তিনি ঢাকা ১৭ আসনের উপনির্বাচনে নায়ক ফারুকের শূন্য আসনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন।

জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর যে কজন দেশের সিনেমার হাল ধরেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ফেরদৌস আহমেদ। শুরু করেছিলেন ছটকু আহমেদের 'বুকের ভেতর আগুন' ছবি দিয়ে। ছবিটি অবশ্য সালমান শাহ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। সালমান শাহর মৃতু্যর পর ফেরদৌস এই ছবিতে কাজ করেন। নায়ক হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের কলকাতায় ফেরদৌসের রাজকীয় অভিষেক ঘটে 'হঠাৎ বৃষ্টি' ছবি দিয়ে। বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত 'হঠাৎ বৃষ্টি' তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। বাংলাদেশ ও ভারতের কলকাতায় ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য পায়। যাকে বলে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন ফেরদৌস। আর এবার প্রথমবারের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েই বাজিমাত করলেন তিনি। রুপালি পর্দার রাজকীয় নায়ক থেকে মাঠেরও রাজকীয় নায়ক বনে গেলেন ফেরদৌস। তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৮৯৮। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মো. শাহজাহান পেয়েছেন মাত্র দুই হাজার ২৫৭ ভোট।

সিনেমা প্রযোজনায়ও সফল ফেরদৌস। তার প্রথম প্রযোজিত সিনেমা 'এক কাপ চা'। এরপর প্রযোজনা করেছেন 'গাঙচিল' নামের একটি ছবি। নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল পরিচালিত এই ছবিতে চিত্রনায়িকা পূর্ণিমার বিপরীতে অভিনয় করছেন তিনি। এ ছবিটি এখন মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য এ পর্যন্ত পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ফেরদৌস। গত বছর ১১ আগস্ট এবং ১৮ আগস্ট ফেরদৌস আহমেদ অভিনীত দুটি সিনেমা মুক্তি পায়। দুটোই সরকারি অনুদানে নির্মিত। একটি হৃদি হক পরিচালিত '১৯৭১ সেইসব দিন'। আরেকটি এফ এম শাহীন ও হাসান জাফরুল মিতুল পরিচালিত 'মাইক'। মাইক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এক সময়ের ছোটপর্দার দর্শকপ্রিয় তারকা অভিনেত্রী তানভীন সুইটির বিপরীতে। সর্বশেষ মুক্তি পায় তার একটি প্রেমের সিনেমা, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত 'সুজন মাঝি'।

বাংলাদেশের চিত্র নায়কদের মধ্যে ফেরদৌস আহমেদ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর সিনেমায় অভিনয় করেছেন। '১৯৭১ সেইসব দিন' ছাড়াও তার উলেস্নখযোগ্য সিনেমা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত 'গেরিলা'। এই সিনেমাটিতে অভিনয় করতে পেরে ফেরদৌসের নিজেরও একটা আলাদা তৃপ্তি রয়েছে। এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আসলে কিছু কিছু সিনেমা তো ক্লাসিক হয়ে যায়, 'গেরিলা' তার মধ্যে একটি। গেরিলাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিটায় ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার বিষয়ও উঠে এসেছে। এ দুটি কারণেই 'গেরিলা' মনে রাখে তাই আমাকেও মনে রাখে। আর 'হঠাৎ বৃষ্টি'র কথা কী বলব, ওটার থেকেও আরো অনেক ভালো কাজ করেছি কিন্তু মানুষের মন ওখানেই আটকে গেছে।'

গত বছর সিনেমা মুক্তির সংখ্যায় ফেরদৌস আহমেদ অনেকটাই এগিয়ে আছেন। সামনে আরও কয়েকটি সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় আছে তার। 'মানিকের লাল কাকড়া', 'দামপাড়া', 'দখিনো দুয়ার', 'আহারে জীবন', 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি', 'যদি আরেকটু সময় পেতাম' নামের ৬টি সিনেমা। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য শুদ্ধমান চৈতন পরিচালিত 'দামপাড়া'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে