পৃথিবীর শ্বাস-প্রশ্বাসের নজর রাখছে স্যাটেলাইট
পৃথিবীতে যত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, এর অর্ধেকই কিন্তু শুষে নেয় সমুদ্র আর মহাসমুদ্র। কিন্তু প্রত্যেক বছরই সমান পরিমাণে শুষে নেয় না। কোনো বছর হয়তো ২৫ শতাংশ আবার কোনো বছর ৮০ শতাংশ। এর ফলে কোথাও বেশি তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোথাও খরা দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো, নাসার এই স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, গত দুই বছর কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল গত ১০ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
এবিএম সাইফুল ইসলাম গাজী
পৃথিবীর কার্বন ডাই অক্সাইডের ওপর নজর রাখার জন্য উৎক্ষেপণ করা হয়েছে ছিল একটি স্যাটেলাইট। নাম ও সি ও টু। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এটি উৎক্ষেপণ করেছিল ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। এই প্রথম সেখান থেকে পৃথিবীতে তথ্য পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে পাওয়া গেছে কার্বন ডাই অক্সাইড সম্পর্কে নতুন কিছু ধারণা।
আমরা সবাই জানি, বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কারণ, আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়াচ্ছি, বন-জঙ্গলের গাছপালা কেটে ফেলছি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বৃদ্ধিটা কিন্তু উঠানামা করে। এই কার্বন ডাই অক্সাইডকেই দায়ী করা হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য।
কার্বন অবজারভেটরি স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটি দেখছে পৃথিবী কীভাবে শ্বাস নেয়, কোথায় কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি এবং পরিবেশের কারণে, এটি কীভাবে প্রভাবিত হয়। ও সি ও টু স্যাটেলাইট প্রত্যেক মাসে দুইবার পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসে। সারা বিশ্বে স্থাপিত দেড়শটির মতো কেন্দ্রে এই স্যাটেলাইট থেকে তথ্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অদৃশ্য এই কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসকে স্যাটেলাইটটি কীভাবে দেখতে পায়।
এই প্রকল্পের উপ-পরিচালক ও বিজ্ঞানী আনম্যারি এল্ডারিং বলেছেন, 'পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়েছে সূর্যের আলো যখন বায়ুমন্ডলের ভেতর দিয়ে আমাদের স্যাটেলাইটে পৌঁছে গিয়েছে। সেটা মেপে দেখার জন্য আমরা একটা পদ্ধতি ব্যবহার করি।'
'কিছু কিছু অণু আছে, যা খুব নির্দিষ্ট আকারে ওই আলোকে ধারণ করতে পারে। কার্বন ডাই অক্সাইড হচ্ছে এমন একটি গ্যাস, যা আলোর বর্ণচ্ছটাকে পরিবর্তন করতে পারে। আমরা তখন আলো ও কার্বন ডাই অক্সাইডের [ওয়েভ লেন্থ] তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পরিমাপ করি। সেই পরিমাপ থেকে আমরা বুঝতে পারি, আলোর ভেতর দিয়ে কতটুকু কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে, স্যাটেলাইটে গিয়ে পৌঁছেছে।'
এই স্যাটেলাইটের উদ্দেশ্য হলো- পৃথিবীর চারপাশে কোথায় কতটুকু কার্বন ডাই অক্সাইড আছে, এর একটি মানচিত্র তৈরি করা।
তিনি বলেন, 'কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎস কি, বায়ুমন্ডলে এর প্রভাব কি ধরনের, সমুদ্রের সঙ্গে এটি কি ধরনের আচরণ করে- এসব জানার জন্যই এই স্যাটেলাইলটটি পাঠানো হয়েছে। এসব বোঝার জন্য প্রত্যেক কিলোমিটারে কি হচ্ছে, সেটা জানার দরকার নেই। কারণ, পরিবেশের ওপর কার্বন ডাই অক্সাইডের যে প্রভাব পড়ে, সেটা একটা বৃহৎ ও বিস্তৃত পরিসরেই ঘটে থাকে।'
'কোথায় কোন অরণ্যে বা কোন জায়গায় কি হয়েছে, এসব তথ্য থেকে আমরা একটা ধারণা পাই। শুধু এক দিনেই আমরা পাই এক লাখেরও বেশি তথ্য। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আমরা পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের ব্যাপারে একটা ধারণা পেতে পারি,' বলেন তিনি।
'এখন আপনি যদি জানতে চান, গত মে মাসে কি হয়েছিল, এই স্যাটেলাইট থেকে আমাদের কাছে ওই এক মাসে যে ৩০ লাখেরও বেশি তথ্য এসেছে, সেসব থেকে আমরা বুঝতে পারব যে, ওই মাসে আসলেই কি হয়েছিল।'
এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, সেসব থেকে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, যে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রত্যেক বছরই বাড়ছে।
কিন্তু এই বৃদ্ধিটা যে সব সময় একই হারে বাড়ছে, তা নয়। দেখা গেল, কোনো মাসে হয়তো বেশি আবার কোনো মাসে কম। এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে
বিজ্ঞানী আনম্যারি এল্ডারিং বলেছেন, এই কার্বন-চক্রের দুটি প্রধান দিক আছে। 'একেক ঋতুতে এর পরিমাণ একেক রকমের হয়। বিশেষ করে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে। এই অংশেই কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের বসবাস। এখানেই অনবরত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হচ্ছে আর সেটা হচ্ছে মানুষের কারণে।'
'কিন্তু দেখা গেছে, যেসব জায়গায় বসন্তকাল আসে, সেখানকার বায়ুমন্ডলে এই কার্বন ডাই অক্সাইডের চিত্রটা একটু বদলে যায়। এর কারণ হলো, সে সময় গাছপালায় পাতা গজায় এবং গাছগুলো খুব দ্রম্নত বড় হতে থাকে। এসব গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয়। ফলে সেসব জায়গায় গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব কমে যায়। কিন্তু দেখা গেছে, শীতকালে গাছপালাগুলো প্রায় মরে যায়, কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন ঘটতেই থাকে। ফলে বায়ুমন্ডলে এই গ্যাসের ঘনত্ব বাড়তেই থাকে। ফলে এটা কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। অর্থাৎ নির্গমন অব্যাহত থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন সময় কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ উঠা নামা করে।'
মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে যত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, এর অর্ধেকই কিন্তু শুষে নেয় সমুদ্র আর মহাসমুদ্র। কিন্তু প্রত্যেক বছরই সমান পরিমাণে শুষে নেয় না। কোনো বছর হয়তো ২৫ শতাংশ আবার কোনো বছর ৮০ শতাংশ। এর ফলে কোথাও বেশি তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোথাও খরা দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো, নাসার এই স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, গত দুই বছর কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল গত ১০ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।