প্রযুক্তির দুনিয়ায় হ্যাকিং ও হ্যাকার

প্রযুক্তির অগ্রগতি সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে হ্যাকারদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় যে অপরাধটি ঘরের বাইরে গিয়ে করতে হতো, এখন তা অপরাধীরা করছে ঘরে বসেই। টাকাও নিচ্ছে ঘরে বসে। ঘটছে সাইবার অপরাধের মতো ঘটনা। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া 'হ্যাকার' মুভিটি অনেকেই দেখে থাকবেন। সময় সময় সরকারি ওয়েবসাইটগুলো হস্তগত হয় হ্যাকারদের। গত বছর জুলাইয়ে প্রযুক্তি পোর্টাল টেকক্স্যাঞ্চে বাংলাদেশের সরকারি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে সংরক্ষিত তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর প্রকাশের পর নাগরিকদের তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়।

প্রকাশ | ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

অলোক আচার্য
মোবাইল বা ল্যাপটপ আপনার, ব্যবহার করেন আপনি অথচ আপনার অজান্তেই দূর থেকে কেউ সেই ডিভাইসে প্রবেশ করে দিব্বি সব বদলে দিচ্ছে, আপত্তিকর ছবি ছেড়ে দিচ্ছে অথবা আপনার একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে পাসওয়ার্ড জেনে নিয়ে। কি সাংঘাতিক অবস্থা, ভাবতে পারেন? জ্বী, এই বিষয়টির নামই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে হ্যাকিং। যারা এই কাজটি সযত্নে করে চলেছে, তাদের বলা হয় হ্যাকার। এক সময় প্রযুক্তির এতটা বাড়-বাড়ন্ত ছিল না, ফলে এসব হ্যাকারও ছিল না। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেই একদল সুক্ষ্ন মস্তিষ্কের প্রযুক্তিবিদেরও আগমন ঘটে, যারা এই কাজগুলো নির্দ্বিধায় করছেন। এটা সত্যি যে, এসব হ্যাকার অত্যন্ত দক্ষ এবং তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেকের থেকে অনেকটা এগিয়ে। তারা অনেকেই তাদের এই ব্রেইন বা উর্বর মস্তিষ্কটাকে একটু ভিন্নপথে পরিচালিত করছে, যা অবশ্যই আইনগতভাবে অবৈধ বা ঠিক নয়। তবে মেধাবী এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আগের দিনে কম্পিউটারের এত চলন ছিল না তখন হ্যাকাররা শুধু ফোন হ্যাকিং করত। তারা বিভিন্ন কমিউনিকেশন সিস্টেমকে হ্যাক করে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করত। এবার প্রশ্ন আসতে পারে, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে হ্যাকাররা কি আয় করতে পারে? পারে। অনেকেই উপার্জন করে। তবে সেটি যে অনেক ক্ষেত্রেই অবৈধপথে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে হ্যাকিংয়ের জগতে ইথিক্যাল হ্যাকিং শব্দটিও যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এই শক্তিকে আপনি ভালো কাজেও ব্যবহার করতে পারেন। একজন হ্যাকার যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো সফটওয়ারের বা কোনো ওয়েবসাইটে ঢুকে সেটির দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে, তবে সেটি অপরাধ হিসেবে আর গণ্য হয় না। কারণ, সে কোনো ক্ষতি করেনি। এর বিনিময়ও অর্থ পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রযুক্তির দুর্বলতা দেখিয়ে দেওয়া আরকি। সেবার ত্রম্নটি বা নিরাপত্তা দুর্বলতা (বাগ) খুঁজে বের করতে অভিজ্ঞ সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের সাহায্য নিতেই মূলত এ ধরনের হ্যাকিংকে উৎসাহিত করে খোদ সফটওয়্যার কোম্পানি বা ওয়েবসাইট কর্তৃপক্ষ। গুগল, ফেসবুক (মেটা), মাইক্রোসফট এবং অ্যাপলের মতো টেক জায়ান্ট বছরজুড়েই নিয়মিত এই বাগ বাউন্টিংয়ের আয়োজন করে। তাদের মধ্যে আইওএস ডিভাইসের প্রাথমিক অ্যাক্সেস বা পুরো সিস্টেম হ্যাকিংয়ের জন্য জিরো-ডে ভঙ্গুরতা খুঁজে দিতে অ্যাপল ১ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেয়। এক কাঠি সরস অ্যান্ড্রয়েডের ত্রম্নটি ধরতে গুগল দেয় ১.৫ মিলিয়ন ডলার। মাইক্রোসফট দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার। এমনকি ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার পুরস্কার দেয় টেসলা। অনেক সময় এসব দক্ষ হ্যাকার বা প্রযুক্তিবিদদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চাকরিও দেয় মোটা বেতনে। কি ভাবছেন চেষ্টা করবেন? সে করতে পারেন। কারণ, এটা আপনার প্রযুক্তির ভবিষ্যৎকে আরও শক্তিশালী করবে। হ্যাকিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে তথ্য বা ফাইল চুরি বা পরিবর্তন করার জন্য কেউ কোন বৈধ অনুমতি ছাড়া কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে। এই যে অনুমতি ছাড়া আরেকজনের কম্পিউটারে প্রবেশ করছে, এর একটি অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের ওয়েবসাইটও হ্যাক হয়, হ্যাকারদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। আবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তথ্য চুরি করে টাকার বিনিময় সেগুলো ফিরিয়ে দেয় হ্যাকাররা। সে ক্ষেত্রে হ্যাকিং হলো- মেধার চূড়ান্ত অবমূল্যায়ন। এই মেধাই একটু সৎ পথে ব্যবহার করলেই দেশ ও জাতির উপকার হতো। অনেক সময় এক দেশের হ্যাকাররা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য দেশের বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাক করে। আগেই বলেছি, হ্যাকাররা সুক্ষ্ন ব্রেইনের অধিকারী হয়ে থাকে। তারা কোনো ডিভাইসের অথবা কোনো ওয়েবসাইটের ত্রম্নটি খুঁজে বের করে এবং সেই জায়গা দিয়েই হ্যাক করে। তারা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত বা আর্থিক ডিটেইলসগুলো ধরতে ব্রাউজার হাজ্যিাক, স্পুফিং, ফিশিং ইত্যাদি কৌশলগুলোকে কাজে লাগায়। অনেক সময় আমাদের লোভও হ্যাকারদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে। অর্থাৎ তারা যে লোভ দেখায় সেই লোভের বশবতী হয়েই আমাদের ডিভাইস হ্যাকিংয়ের শিকার হয়। ই-মেইলের মাধ্যমে তারা টোপ দিতে পারে। এটাকে বলে ফিশিং। প্রচুর টাকা লটারিতে জিতে যাওয়ার লোভ দেখানো হয় বা এ রকম কোনো উপায় যেখানে ব্যবহারকারী সহজেই একটি মেইল খুলতে আগ্রহী হন। আর খুললেই সর্বনাশ। সব চলে যাবে হ্যাকারের কাছে। এভাবে ছাড়াও এই যে আমাদের দেশে প্রতারকরা কৌশলে মানুষের পাসওয়ার্ড জেনে নিয়ে বিকাশ বা নগদ থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। এসবও কিন্তু হ্যাকিংয়ের আওতাভুক্ত। হ্যাকার সাধারণত ৩ প্রকার হয়ে থাকে। হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার হলো যারা অন্যের কম্পিউটার বা ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে বিভিন্ন বিষয় দেখে কিন্তু কোনো প্রকার ক্ষতি বা পরিবর্তন না করে বের হয়ে আসে। এরপর গ্রে হ্যাট হ্যাকাররা যখন কোনো একটি সিকিউরিটি সিস্টেমের ত্রম্নটি বের করে তখন সে তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে। বস্ন্যাক হ্যাট হ্যাকার সবচেয়ে ভয়ংকর হ্যাকার হচ্ছে বস্ন্‌্যাক হ্যাট হ্যাকার। তারা কোনো ত্রম্নটি বের করলে সেটিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগায়। সেটা নষ্ট করে। বিভিন্ন ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়। ভবিষ্যতে আবার যাতে সেখান থেকে সুবিধা নিতে পারে, সে ব্যবস্থা করে রাখে। তারা সাধারণত ক্রেডিট কার্ডের গোপন নম্বর ও ব্যাংক ডেটাবেজের তথ্যসমূহ নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা ছাড়াও আরও কিছু টাইপের হ্যাকার রয়েছে। তবে প্রযুক্তিতে দক্ষ আজকাল অনেকই সাগ্রহে দক্ষ হ্যাকার হিসেবে গড়ে উঠছেন। যদি কারও ক্ষতি না করেন, তাহলে সব ঠিক আছে। ইতিহাসে অনেক ছোট বয়সি হ্যাকারের কথা শোনা যায়। তাদের মধ্যে একজন ফিনল্যান্ডের বয়সি জুলিয়াস কিভিমাকি। এরা যখন কোন একটি সিকিউরিটি সিস্টেমের ত্রম্নটি বের করে তখন সে তার ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করে। জুলিয়াসের নজরে ছিলেন সাইকোথেরাপি নিতে আসা রোগীরা। অভিযোগ, থেরাপি নেওয়া প্রায় ৩৩ হাজার মানুষের তথ্য হাতিয়ে নিয়ে বস্ন্‌্যাকমেল করেছেন জুলিয়াস। জুলিয়াস মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকে হ্যাকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। অবশেষে তাকে শাস্তি দেয় আদালত। প্রযুক্তির অগ্রগতি সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে হ্যাকারদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় যে অপরাধটি ঘরের বাইরে গিয়ে করতে হতো, এখন তা অপরাধীরা করছে ঘরে বসেই। টাকাও নিচ্ছে ঘরে বসেই। ঘটছে সাইবার অপরাধের মতো ঘটনা। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া 'হ্যাকার' মুভিটি অনেকেই দেখে থাকবেন। সময় সময় সরকারি ওয়েবসাইটগুলো হস্তগত হয় হ্যাকারদের। গত বছর জুলাইয়ে প্রযুক্তি পোর্টাল টেকক্স্যাঞ্চে বাংলাদেশের সরকারি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে সংরক্ষিত তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর প্রকাশের পর নাগরিকদের তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়। চলতি বছরের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি সংস্থার কর্মীদের আইডি ব্যবহার করে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ও মুঠোফোনের কল ডেটা রেকর্ডসহ (সিডিআর) নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ও অনলাইনে বিক্রির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এভাবেই হ্যাকিংয়ের ভালো এবং মন্দ দুই-ই রয়েছে তবে মন্দ দিকটাই এ পর্যন্ত বেশি শক্তিশালী অন্যের ক্ষতি করাই যে মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে হ্যাকিংয়ের। ফলে ক্রটিমুক্ত সফটওয়্যার এবং ওয়েবসাইট তৈরিতে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার বিকল্প নেই এবং অবশ্যই হ্যাকিং সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে একেবারে শৈশব থেকেই।