নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল প্রকৃতি অসংখ্য নদ-নদী, হাওড়, চলনবিল, পুকুর এবং জলাভূমিতে সমৃদ্ধ। উন্মুক্ত জলাশয়ের এই সমৃদ্ধতার কারণে স্বভাবতই হাঁস পালনের একটি উপযোগী ক্ষেত্র বাংলাদেশ।
জলাশয়ে হাঁস পালন উপযোগিতার অন্যতম কারণ হাঁসের প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় খাবারের একটি অংশ তারা জলাভূমি থেকে আহরণ করে থাকে।
হাঁসের রোগ-বালাই তুলনামূলকভাবে কম ও ব্যবস্থাপনা সহজ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রান্তীয় পর্যায়ে ছোট ও মাঝারি আকারের অনেক খামার ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একাংশের কাছে হাঁসের মাংস ও ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঋতু পরিক্রমায় শীতের আগমন ঘটলে হাঁসের মাংসের চাহিদা আরও বেড়ে যায়।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মূলত ডিম উৎপাদনকারী হাঁসের জাত বিদেশ থেকে আমদানি করছে। উক্ত হাঁসের জাতগুলো ডিম ও মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। হাঁসের মাংসের চাহিদার প্রেক্ষিতে নিকট-অতীতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পেকিং জাতের হাঁস আমদানি করে।
তবে, আবদ্ধ (ওহঃবহংরাব) ব্যবস্থায় পেকিং থেকে কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়া গেলেও প্রান্তিক পর্যায়ে আধা-আবদ্ধ (ঝবসর-ওহঃবহংরাব) ব্যবস্থায় এর উৎপাদনশীলতা আশানুরূপ নয়, ফলে খামারি পর্যায়ে উর্বর জাতের লালন-পালন লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম ভুঁঞা, প্রান্তিক খামারিদের কথা বিবেচনায় রেখে একটি সংকর জাতের হাঁস উদ্ভাবন করেন।
বাউ বস্ন্যাক অ্যান্ড হোয়াইট একটি সম্ভাবনাময় সংকর জাতের হাঁস। জাতটি ২০ সপ্তাহ বয়সে ডিম উৎপাদন শুরু করে এবং ডিমের বার্ষিক উৎপাদন হয় ২২০-২৩০টি, যেখানে ডিমের গড় ওজন প্রায় ৭০ গ্রাম। এ ছাড়াও, এই জাতের ১০ সপ্তাহে গড়ে দুই কেজি ওজন হয় এবং মাংস উৎপাদনের শতকরা হার (উৎবংংরহম চবৎপবহঃধমব) ৬২-৬৩%। ডিম এবং মাংস উভয় উৎপাদনে একটি উপযোগী জাত বাউ বস্ন্যাক আ্যন্ড হোয়াইট। গবেষণায় দেখা গেছে, কাঙ্খিত উৎপাদনের জন্য খাবারে ১৮.০-১৮.৫ ক্রুড প্রোটিন এবং ২৮০০-২৮৫০ কিলোক্যালরি শক্তি থাকা প্রয়োজন।
ইতোমধ্যেই উদ্ভাবিত হাঁসের কৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যাবলী সম্পন্ন করা হয়েছে, যা হাঁসটির বিশেষত্ব উপস্থাপনের জন্য যথেষ্ট।
বর্তমানে সংকর জাতের হাঁসটি ষষ্ঠ জেনরাশন লালন-পালন করা হচ্ছে। ক্রমাগত নিরীক্ষণের মাধ্যমে জাতটি পঞ্চম প্রজন্মের দৈহিক বৃদ্ধি ও উৎপাদন দক্ষতা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। হাঁসটিতে দেশি জাতের জিন বিদ্যমান রয়েছে, তাই বাংলাদেশের আবহাওয়ার অধিকতর উপযোগী। হাঁসটির মৃতু্যহার ৪২ সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র ৩ শতাংশের কাছাকাছি (গবেষণালব্ধ ফলাফল) এবং ১০-১১ সপ্তাহেই হাঁসটির বাজারজাতকরণের উপযুক্ত সময়। অধিকতর উৎপাদনশীল হওয়ায় হাঁসটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে। এরই মধ্যে, গ্রামীণ পর্যায়ে লালন-পালনের জন্য আগ্রহী খামারিদের মধ্যে হাঁস এবং ডিম হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে পশুপ্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম ভুঁঞা বলেন, 'বাউ বস্ন্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ভবিষ্যতে প্রান্তিক খামারিদের জন্য উপযুক্ত জাত। বাংলাদেশে বিদ্যমান দেশি জাতের হাঁসের তুলনায় এই সংকর জাতটি অধিকতর মাংস এবং ডিম উৎপাদন করে থাকে। প্রাণিজ প্রোটিন বিশেষ করে হাঁসের মাংসের চাহিদা পূরণে এই জাতটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশা করছি।'