গ্রহাণু আর ধূমকেতুর জগতে
গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করার ঘটনাটি দুর্লভ হলেও এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে বেশ খারাপ। এর মানে হলো, আমাদের যেমন বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া যাবে না, তেমনি ব্যাপারটাকে এড়িয়েও যাওয়া যাবে না। নাসার গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীর নিকটবর্তী প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রহাণুর ব্যাস হলো ১ কিলোমিটারের বেশি। তবে এর খুব কমই বায়ুমন্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে আছড়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে প্রয়োজন আরও অনেক গবেষণা এবং সার্বক্ষণিক লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের ওপর
প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
সাইফুল ইসলাম
পৃথিবীতে প্রাণ জন্ম বা সৃষ্টি হওয়া সম্পর্কে ধূমকেতুর কোনো যোগসূত্র আছে কিনা? ৬৭৬-চ ধূমকেতুর পেছনে, রোজেটা নামক মহাকাশযানটি ১০ বছর ৫ মাস ৪ দিন ছোটাছুটির পর আবশেষে ওই ধূমকেতুর কক্ষপথে পৌঁছতে পেরেছে। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এটাকে দেখা হচ্ছে যুগান্তকারী উত্তেজনাকর এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে। এর আগে কোনো ধূমকেতুকে এত কাছ থেকে দেখা সম্ভব হয়নি। এই পৃথিবীতে বার্তা পাঠাচ্ছে রোজেটা, আবার রোজেটাতেও বার্তা পাঠানো হচ্ছে পৃথিবী থেকে। বার্তা পাঠাতে বা পৌঁছতে সময় লাগছে ২০ মিনিট করে। এটাকে বলা হচ্ছে উত্তেজনাকর এক মিশন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মহাকাশযান থেকে ওই ধূমকেতুর বেশ কিছু ক্লোজআপ ছবি পাঠানো হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ছবি পাওয়া যাচ্ছে। তারা বলছেন, এত ছবি যে সেগুলো মেঝের ওপর রেখে দেখতে দেখতেই আমাদের এক সপ্তাহ কেটে গেছে।
রাশিয়ার দুইজন বিজ্ঞানী (ভিতালি নোভস্কি ও আর্তিয়েম নভোচিনক) একটি ছোট প্রতিফলক দূরবীক্ষণ দিয়ে আইসন ধূমকেতুটি আবিষ্কার করেন। এই দুরবিনের নাম ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক (আইএসওএন)। এই ধূমকেতুর প্রকৃত নাম সি-২০১২ এসআই। তবে বলা হচ্ছে এই ধূমকেতুর নাম বিজ্ঞানীদ্বয়ের নামেও হতে পারে। মূল কথা হলো- এই ধূমকেতুকে সবাই আইএসওএন নামে অভিহিত করছে। এই ধূমকেতু নিয়ে গত বেশকিছু দিন ধরেই সারা বিশ্বের বিজ্ঞানমহলে শুরু হয়েছে বেশ চাঞ্চল্য। কারণ, একটা ধূমকেতু দেখার সুযোগ মানুষের জীবনে একবারই আসে। এর মাথাটা ছিল প্রায় ২ কিলোমিটার চওড়া। আর লেজের দৈর্ঘ্য ছিল কয়েক মিলিয়ন কিলোমিটার। বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এটা উত্তর গোলার্ধের দেশগুলো থেকে দেখা যাবে। কিন্তু সূর্যের প্রচন্ড তাপে সৃষ্টি হয়েছে ধূলিকণার বৃষ্টি। বিজ্ঞানীরা একে ধূমকেতু ভেঙে যাওয়ার ফল বলে মনে করছেন। এ ঘটনায় আশাহত হলেন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানমহল ও কৌতূহলী আমজনতা। সূর্যের কাছে বহিঃমন্ডলে গমনের পর নিখোঁজ ছিল আইসন। সূর্যের তীব্র আলোয় ঢাকা পড়ে যাওয়া আইসনকে নাসার ৮টি টেলিস্কোপ তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পায়নি। আর ৩০০ বছরে এমন উজ্জ্বলতর আকাশ ঝাড়ু দেখার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল? গত ২৮ নভেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত নাসার অবজারভেটরি থেকে কোনো খবর দেওয়া হয়নি। যেন আশার প্রদীপ নিভে গেল। পরে আশার আলো দেখালেন মার্কিন নৌসেনা একদল জ্যোতির পদার্থবিদ। আরিজোনা বিশাল নৌসেনার বড় ল্যাবের সৌর টেলিস্কোপে ধরা পড়েছে আলোর বিন্দুর মতো নড়াচড়া করছে এমন কিছু ছবি। তারা মনে করছেন, সূর্য নিঃশেষ করতে পারেনি আইসনকে। মহাজাগতিক এই খবরে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যা আইসনের অংশবিশেষ হতে পারে। পরে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) বলেছে আবার দেখা যেতে পারে আইসনকে। তাই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নজর রাখতে বলছে নাসা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এ সময় পূর্ব-দক্ষিণ বা পূর্ব আকাশে দেখা যাবে আইসনকে। সূর্য যখন অস্ত যাবে, সে সময় ফের পশ্চিম বা দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে দেখা যাবে এটাকে। আর এটা আবিষ্কার হয়েছে মাত্র ১৪ মাস আগে, এর মধ্যেই অপমৃতু্যর ছোবলে পড়ে আইসন। নেপচুনের পুরোট ক্লাউড গগণের তুষারআবৃত অংশে জন্ম হয়েছিল এই 'কমেট অব দ্য সেঞ্চুরির'। ভেঙে গেলেও তা থেকে যে তথ্য পাওয়া যাবে, তা দিয়ে সৌরমন্ডলের অনেক অজানা রহস্য আবিষ্কার করা যাবে। ফিনিক্সের (মঙ্গল যান) মতো যদি আগুনের হলকা থেকে বেঁচে যায়, তাহলে বের হয়ে আসবে আকাশ দীপাবলী। ইতোমধ্যে যার লেজের দৈর্ঘ্য হয়েছিল ৮০,০০০০০ মাইল বা ১,২৮,৮০,০০০ কিলোমিটার। যা ছিল মহাকাশে আলোর ফুলঝুরি। যা আগে দেখেননি বিজ্ঞানীরা। এই বার্তাই ইমেলে জানিয়েছেন নাসার কর্মকর্তা কার্ল বাট মার্স। কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল? তা জানার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তারা। মহাকাশের টেলিস্কোপগুলো নিরন্তন নজর রেখে চলেছে এর গতিপ্রকৃতির ওপর। আইসন সূর্যের টান এড়াতে পারলে ডিসেম্বরে তার ওপর নজরদারি চালাবে সদ্য পাঠানো একটি টেলিস্কোপ। মিস করলে, আগামী ৩০০ বছরে এ রকম ধূমকেতু আসার আর কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিজ্ঞানীরা। এই উজ্জ্বল ধূমকেতুকে বলা হচ্ছে কমেট অব দ্য ইয়ার। আবিষ্কারের পর আইসনকে প্রথমবারের মতো পৃথিবী থেকে দেখা গেল ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। পৃথিবী থেকে তখন দূরত্ব ছিল ৮৩.৮ কোটি কিলোমিটার। এর উৎপত্তি হয়েছিল নেপচুন পুঞ্জের ক্লাউড থেকে। এর নামকরণ করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের নামে (আইসন)। এই ল্যাবের ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের টেলিস্কোপে প্রথম ধরা পড়ায় এর নাম রাখা হয় আইসন।
নাসার ঘবধৎ ঊধৎঃয ঙনলবপঃ চৎড়মৎধস থেকে প্রকাশিত এক ম্যাপে দেখা যায়, ১৯৯৪-২০১৩ পর্যন্ত ২০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এসে পড়েছে কমপক্ষে ৫৫৬টি জ্বলন্ত গ্রহাণু। মাটিতে পড়ার আগেই বায়ুমন্ডলের ঘর্ষণে তাদের বেশির ভাগ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর ব্যতিক্রম হলো ১৫ ফেব্রম্নয়ারি, ২০১৩-এর চেলইয়াবিন্সক উল্কাপাত, যেখানে ১৭-২০ মিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু বিস্ফোরিত হয় রাশিয়ার চেলইয়াবিন্সক শহরের ওপর। এতে ভেঙে পড়ে অনেক জানালা আর আহত হয় হাজারখানেক মানুষ। কিন্তু এর চেয়েও বড় কোনো গ্রহাণুর আঘাতে আরও অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এতে আমাদের ঠিক কতটা চিন্তিত হওয়া উচিত?
নাসার ড. এমি মেইনজার বলেন, গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করার ঘটনাটি দুর্লভ হলেও এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে বেশ খারাপ। এর মানে হলো, আমাদের যেমন বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া যাবে না, তেমনি ব্যাপারটাকে এড়িয়েও যাওয়া যাবে না। নাসার গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীর নিকটবর্তী প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রহাণুর ব্যাস হলো ১ কিলোমিটারের বেশি। তবে এর খুব কমই বায়ুমন্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে আছড়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে প্রয়োজন আরও অনেক গবেষণা এবং সার্বক্ষণিক লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের ওপর। ঘঊঙপধস নামের এক নতুন স্পেস টেলিস্কোপ তৈরির প্রস্তাব করা হচ্ছে, যার সাহায্যে এসব গ্রহাণুর ওপর নজর রাখাটা সহজ হবে।
নাসার তথ্য অনুযায়ী, মোটামুটি প্রতি পাঁচ হাজার বছরে একবার, ফুটবল মাঠের সমান আকৃতির কোনো বস্তু পৃথিবীকে আঘাত করে আর বেশ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।
এদিকে একটি ধূমকেতুর ওপর অবতরণের জন্য ১০ বছর আগে, একটি মহাকাশযানকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। আড়াই বছর ধরে বন্ধ রাখার পর তাকে আবার মহাকাশেই সক্রিয় করে তোলা হয়েছে। এই মহাকাশযানটির নাম হবে রোজেটা। প্রাচীন মিশরীয় সাংকেতিক লিপি হায়ারোগিস্নফিকসের জনক রোজেটা স্টোনের নাম অনুসারে এটার নামকরণ করা হয়েছে রোজেটা। আবার এই ধূমকেতুটির নাম রাখা হয়েছে- ৬৭৬-পি। এটার আরও একটা নাম আছে তা হলো- চুরিমফ গেরাসিমিয়েঙ্কো।
এই যানটি প্রেরণ করেছিল ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি। যার কাজ ছিল-সৌরজগতের আশপাশে থাকা ধূমকেতুতে অবতরণ করে, তার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। চলতে চলতে পথেই যাতে ব্যাটারির চার্জ শেষ না হয়ে যায়, সেই জন্য মহাকাশযানটিকে বিগত আড়াই বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছিল। গত কয়েক দিন আগে সেই যানটিকে আবার সক্রিয় করে তোলা হয়েছে। পৃথিবীতে বসেই বিজ্ঞানীরা সক্রিয় করার কাজটি করেছেন। ধূমকেতু সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানি না। রোসেয় যে ক্যামেরা বসানো আছে, তা দিয়ে ধূমকেতুটাকে বের করা হবে। তার অবস্থান নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা হবে। রোজেটা এরপর তার দিকে ধাওয়া করে উড়ে যাবে। এর ওপর অবতরণের চেষ্টা করবে। ওই ধূমকেতু মাথাটার ব্যাস ৪ কিলোমিটার। এই যানটি যখন ধূমকেতুর চারদিকে ঘুরতে থাকবে। তখন আরও অনেক কিছু জানা যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী জুলাইনাগাদ ধূমকেতু থেকে পৃথিবীতে ছবি পৌঁছতে শুরু করবে। আর তখনই এর গতিবিধির মানচিত্র তৈরি করা যাবে।
এই পৃথিবী থেকে ৫০ কোটি কিলোমিটার দূরে একটি ধূমকেতুর খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণের চেষ্টায় বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে ইউরোপীয় একটি মহাকাশযান। রোজেটার নামের এই যানটার কাজ হচ্ছে- আগামী এক বছর ধূমকেতুটিকে পদক্ষিণ করা। সেখানে একটি ল্যান্ডার বা অবতরণ যান পাঠিয়ে এর উপাদান পরীক্ষা করা। এই মহাকাশযানটি এখন ধূমকেতুর কক্ষপথে পৌঁছেছে, যাতে এটা ধূমকেতুর পাশাপাশি পদক্ষিণ করতে পারে। এই মিশনের সাবেক ম্যানেজার গেরহার্ড শোয়েহেম ১৯৮০'র দশক থেকে এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেছেন, রোজেটার সঙ্গে ধূমকেতুর যুক্ত হওয়ার ফলে এই মিশন সার্থক হয়েছে। তেমনি এই ধূমকেতু নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের শঙ্কা। ধূমকেতুর গতি ও দূরত্বের কারণে এই মিশনটা বিজ্ঞানীদের জন্য কঠিন। আগের মিশনগুলোয় যে মহাকাশযান পাঠানো হয়েছিল, সেগুলো ধূমকেতুর গতির কাছ দিয়ে গেছে। এ জন্য সে মিশন থেকে শুধু ধূলিকণার নমুনা ও কিচু তথ্য পাওয়া গেছে। আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। তবে রোজেটা এবার নির্দিষ্ট একটি ধূমকেতুর কক্ষপথে এক বছর ঘুরবে। তাই আশা করা হচ্ছে, রোজেটা এবার নজিরবিহীন তথ্য সংগ্রহ করবে।
স্পেনে ইউরোপীয় স্পেস অ্যাস্ট্রনমি সেন্টারের গবেষক অধ্যাপক আলভারো গিমেনেজ বলেছেন, এই গবেষণা একবারে মৌলিক। আমরা এমন এক জায়গায় যাব, যেখানে আগে কখনো যাওয়া হয়নি। এটা থেকে সৌরজগৎ সৃষ্টি ও অণু-পরমাণুর উৎস সম্পর্কে আমরা নানা অজানা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইব। তিনি আরও বলেন, সবকিছু যদি পরিকল্পনামাফিক চলে, তাহলে আগামী নভেম্বরনাগাদ তারা রোজেটাকে ফিরিয়ে আনতে সেখানে একটি অবতরণযান পাঠাবেন। ধূমকেতু যেহেতু সৌরজগতের একেবারে আদি পর্বের অবশিষ্ট অংশ।