এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স গবেষণায় অনন্য বাকৃবির এমটিআর ল্যাব

প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

তানিউল করিম জীম
বর্তমানে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শীর্ষ ১০টি সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স। অদূর ভবিষ্যতে সামান্য জ্বর বা সর্দি-কাশিতেই আক্রান্ত হয়ে বিনাচিকিৎসায় মারা যাবে শুধু এই এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের জন্য।  সাম্প্রতিক ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ঘটনাকে প্রায় ১.২৭ মিলিয়ন মৃতু্যর জন্য সরাসরি দায়ী করা হয়েছিল। ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন পর্যন্ত মৃতু্য ঘটাতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের সঙ্গে মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশ সবকিছুই জড়িত। তাই বর্তমান বিশ্বে ওয়ান হেলথের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দিনদিন দেশে যত্রতত্র এন্টিবায়োটিক ওষুধের ব্যবহারের ফলে সেটি মানুষ, পশু-পাখি এবং পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ভয়াবহতা জানার জন্য এবং সেটির প্রভাব দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার উদ্দ্যেশ্যে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে ২০১০ সালে কাজ শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তানভীর রহমান। তার দীর্ঘ ১৪ বছরের গবেষণায় আজ পর্যন্ত প্রায় ১০০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সংশ্লিষ্ট। গবেষণাপত্রগুলো বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনার ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।  অধ্যাপক ড. তানভীর তার গবেষণার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন বর্তমানে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কি অবস্থা এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় কি সেটা জানানোর জন্য। তিনি প্রতিনিয়ত স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি গবেষণা ল্যাবে স্নাতকের শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ করে দেন। যেন উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের শুরু থেকেই ল্যাব ওয়ার্ক এবং পেপার পাবলিকেশনের হাতেখড়ি হয়। ড. তানভীর তার গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বসেরা ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।  সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বিশ্বের প্রথম সারির চিকিৎসা ও বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশনা সংস্থা 'এলসেভিয়ার'-এর সমন্বিত জরিপে গত সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) এ তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞানীদের প্রকাশনা, এইচ-ইনডেক্স, সাইটেশন ও অন্য সূচক বিশ্লেষণ করে তালিকাটি প্রস্তুত করা হয়। এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে গবেষণা শুরুর বিষয়ে ড. তানভীর বলেন, বিদেশে আমার স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি করাকালে জিনোম সিকুয়েন্সিং, বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার ভিরুলেন্স জিন শনাক্তকরণ এবং মলিকুলার পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেইন শনাক্তকরণসহ বিভিন্ন জটিল ও ব্যয়বহুল কাজ শিখেছিলাম। উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে এসে আমি লক্ষ্য করলাম গ্রামীণ পর্যায়ে গবাদি পশু-পাখির চিকিৎসায় পলস্নী চিকিৎসকরা অবাধে এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করে চলেছেন। যা একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার ও অনুজীব বিজ্ঞানী হিসেবে আমার কাছে একটি বিপদসংকেত হিসেবে মনে হয়। পরে ২০১০ সালে আমি চেষ্টা করতেছিলাম বাংলাদেশে এসব কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেওয়ার। কিন্তু যন্ত্রপাতি ও আর্থিক সহযোগিতার অভাবে পুরোপুরিভাবে কাজটি শুরু করতে পারিনি। এরপর আমার নিজস্ব চেষ্টা এবং বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগের সহায়তায় মোহাম্মদ তানভীর রহমান (এমটিআর) নামে ল্যাব মাধ্যমে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে কাজ শুরু করি। কারণ এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। প্রতিটি মানুষ, প্রাণী এ সমস্যায় জর্জরিত এবং পাবলিক হেলথের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইসু্য। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে গবেষণা কার্যক্রমকে আরও যুগোপযোগী করার জন্য আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণায় গবেষণা সংক্রান্ত সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করেছি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালির পেরুজিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চীনের গুয়াংজি ভেটেরিনারি রিসার্চ ইন্সটিটিউট, দক্ষিণ কোরিয়ার কাংওয়ান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির চেরা ডায়াগনস্টিক, নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য ও সমাজ ইন্সটিটিউটের বিশ্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিভাগ, জার্মানির মিউনিখের কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার অটোয়ার কৃষি ও কৃষি খাদ্য বিভাগ। জানা যায়, বিগত কয়েক বছরে এমটিআর ল্যাব থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম প্রান্ত, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস;  রোকেয়া আহমেদ, জর্জিয়া সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র; প্রীতম কুমার, ইউনিভার্সিটি অব উইন্সর, কানাডা; জান্নাতুল ফেরদৌস লায়লা, ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য; লিটন রানা, চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স, চীন; এবং জান্নাত হোসেন, গিফু ইউনিভার্সিটি, জাপানে যুক্ত আছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, গবেষণার স্বার্থে এমটিআর ল্যাবে প্রতিনিয়ত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, পরিযায়ী পাখি, শোভাবর্ধনকারী পাখি, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য, মাছ, ছাদ বাগানের মাটি, শাকসবজি,  বন্যপ্রাণী, চিড়িয়াখানার প্রাণী, গো-খাদ্য এবং চারপাশের পরিবেশ থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে ল্যাবে নিয়ে এসে যেসব জীবাণুর  এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স দেখায় সেসব জীবাণুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরণ কাজ করা হয়। এ ছাড়া ল্যাবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বহনকারী জিন শনাক্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুজীবের শনাক্তকরণে ব্যাকটেরিয়ার পূর্ণাঙ্গ জিনোম এবং মেটা জিনোম সিকুয়েন্সিং করা হয়েছে। যা দেশে এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ল্যাবের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী এবং গবেষণা সহকারী রনি ইবনে মাসুদ বলেন, উচ্চশিক্ষার যাত্রায় নিজেকে এগিয়ে রাখতে, গবেষণায় দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নাই। এমটিআর ল্যাব আমাদের সেই সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমরা যুক্ত হচ্ছি বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমে। উচ্চশিক্ষা যাত্রার শুরুতেই গবেষণা কাজের হাতেখড়ি এবং  বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ শুধু আমাদের আত্মবিশ্বাসই বাড়াচ্ছে না, সঙ্গে আমাদের সুযোগকে আরও বেশি অবারিত করে দিচ্ছে। ড. তানভীর রহমান স্বপ্ন দেখেন, আগামী দিনে উনার  এমটিআর ল্যাবটি একটি রেজিস্ট্যান্স অ্যানালাইসিস এবং জিনোমিক সারভিলেন্সের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে, যেখানে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে বিশদ আকারে গবেষণা হবে। তিনি মনে করেন, গবেষণার জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শুধু ক্যারিয়ারের দিক থেকেই শিক্ষার্থীরা লাভবান হয় না বরং ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন ঘটনা সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জীবনকে অধিকতর সহজ ও সুন্দর করে তোলার দক্ষতা অর্জন করে।