মহাকাশে আবর্জনার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। কিন্তু এভাবে বাড়তে থাকলে বহু ব্যবহৃত কক্ষপথগুলোতে সচল স্যাটেলাইটদেরও বিপদ ঘটতে পারে এবং দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার ধাক্কা এড়াতে গেলে জ্বালানি খরচ হয়। বর্তমানে এসব কারণে বছরে প্রায় ১৪ কোটি ইউরো খরচ হয়। প্রতিবছর একাধিক টন অচল স্যাটেলাইট বায়ুমন্ডলে বাতাসের ঘর্ষণে ভস্মীভূত হয় এবং মাটিতে ভেঙে পড়ে। ভবিষ্যতে যাতে তার প্রয়োজন না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করাই হলো জার্মান গবেষকদের প্রচেষ্টা।
স্যাটেলাইট আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী হয়ে উঠেছে। যোগাযোগ, যাতায়াত, কৃষি থেকে শুরু করে জলবায়ু ও আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে। কিন্তু সময় ও প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে উড়ন্ত এসব যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়ে। তখন আবার নতুন স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সবার আগে অকেজো স্যাটেলাইট পরিষ্কার করতে হবে। তারপর নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা যাবে। এ আবর্জনা ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। রকেট বা মহাকাশযানকে পুরনো স্যাটেলাইট ও মহাকাশ আবর্জনার পাশ কাটিয়ে অত্যন্ত সরু পথ দিয়ে যেতে হবে। মহাকাশ সংস্থাগুলো চালু স্যাটেলাইটগুলোকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি না করলে অন্য বস্তুর সঙ্গে সেগুলোর ধাক্কা লাগতে পারে। আবর্জনার ঘনত্ব এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, কক্ষপথে যে কোনো স্যাটেলাইটের সঙ্গে তাদের দ্রম্নত সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। তখন আর ৪০০ থেকে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে নিম্ন কক্ষপথ ব্যবহার করা যাবে না। সেই পরিস্থিতি যাতে না আসে, আমাদের তা নিশ্চিত করতে হবে। স্যাটেলাইট সাধারণত ৭ থেকে ১০ বছর অথবা তার সামান্য বেশি সময় সক্রিয় থাকে। তারপর সেটিকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করতে হয়। সেখানে যে আবর্জনা আছে, তা অবশ্যই সংগ্রহ করা উচিত।
জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কক্ষপথে আবর্জনার তালিকা তৈরি করে লেজার রশ্মি দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করছে। আগামীতে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার ফরাসি গুইয়ানায় ইউরোপের মহাকাশবন্দর কুরু থেকে ছয় হাজারের বেশি কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠানো হয়েছে। মহাকাশ মহাশূন্য থাকলেও এখন সেখানে পাঁচ লাখের বেশি ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতির টুকরো ঘুরছে ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার গতিতে। এগুলো হলো পুরনো স্যাটেলাইট আর রকেটের টুকরো, যা মহাকাশে অকল্পনীয় বিপদ ঘটাতে পারে। এয়ারোস্পেস সেন্টারের বিজ্ঞানী আডল্ফ গিসেন বলেন, 'আমরা যদি এ মহাকাশ আবর্জনার বিরুদ্ধে কিছু না করি, তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন আমরা স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথে রাখতেই পারব না। স্যাটেলাইট বিকল হচ্ছে, স্যাটেলাইটে স্যাটেলাইটে ধাক্কা লাগছে। একদিকে হাজারখানেক স্যাটেলাইট রয়েছে কক্ষপথে, অন্যদিকে রয়েছে সাত লাখের মতো বিপজ্জনক লোহালক্কড়ের টুকরা।' তারা এক নতুন ধরনের লেজার ব্যবস্থা তৈরি করছেন, যা অত্যন্ত জোরালো ও নিখুঁত। এই লেজারের সাহায্যে মহাকাশে আবর্জনা কমানো হবে। প্রথম কাজটি হবে, পৃথিবীর চারপাশে যে সাত লাখের মতো টুকরা ঘুরপাক খাচ্ছে, সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, ভূপৃষ্ঠ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ঘুরপাক খাওয়া আবর্জনার টুকরাগুলোর গতি কমানো হবে লেজারের কামান দিয়ে, যাতে সেগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢোকার সময় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু মহাকাশ আবর্জনার তালিকা তৈরি করাটা একটি কঠিন কাজ। কারণ মহাকাশে নিত্যনতুন পরিবর্তন ঘটছে, পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। একদিকে স্যাটেলাইটগুলো ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে এর ফলে নতুন আবর্জনা সৃষ্টি হচ্ছে। এটা বাকি স্যাটেলাইটগুলোর জন্য বিপজ্জনক। এছাড়া মহাকাশ আবর্জনার টুকরাগুলোর কক্ষপথ প্রায়ই বদলে যায়। এক সপ্তাহ নজর না রাখলেই সেগুলো কোথায় হারিয়ে যায়, তা নতুন করে খুঁজে দেখতে হয়।
হাই-টেক গবেষণাগারে গিসেন ও তার সহকর্মীরা লেজার কামান নিয়ে কাজ করছেন। তাদের মতে, মহাকাশ আবর্জনার টুকরাগুলোকে দিনরাত পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিষুবরেখা বরাবর সারা পৃথিবীজুড়ে নজর রাখতে হবে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র না থাকলেও সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে সহযোগিতার পরিকল্পনা চলেছে। আডল্ফ গিসেন বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হলো আবর্জনা সরানো, যেটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। আজ যে ধরনের ছোট ছোট টুকরা ঘুরছে, তা একমাত্র লেজার দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু লেজার তৈরি করতে দশ বছরের বেশি সময় লেগে যাবে।' অন্যদিকে, পৃথিবীর কক্ষপথে আবর্জনা দূর করতে এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টার 'ডিএলআর'। ভবিষ্যতে তাদের রোবট এ অসাধ্য সাধন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পৃথিবীর কক্ষপথে যেখানে টেলিকমিউনিকেশন স্যাটেলাইট থাকে এবং ভূপৃষ্ঠের কাছের অংশেই এ আবর্জনার সংখ্যা বেশি থাকে। জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের হাউকে ফিডলার বলেন, 'মানুষের হাতের মুঠোর মতো ছোট্ট একটা টুকরাও যদি স্যাটেলাইটকে ধাক্কা মারে, তবে সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। ঘণ্টায় কয়েকশ' কিলোমিটার বেগে একটা গাড়ি ধেয়ে এলে যা হয়, মহাকাশে ছোট্ট টুকরোও সেই ক্ষমতা রাখে।'
২০০৯ সালে মহাকাশে রাশিয়া ও আমেরিকার দুই স্যাটেলাইটের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছিল। তাদের ভাঙা টুকরোগুলো মেঘের মতো গোটা বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের গবেষকরা এসব আবর্জনা পরিষ্কার করতে চান। কক্ষপথে এ অভিযানের পোশাকি নাম 'ডেয়স'। এ যেন এক পরিচ্ছন্নকর্মী, যিনি পুরনো স্যাটেলাইট ধরে তাতে জ্বালানি ভরে আবার মহাকাশে ছেড়ে দেবেন অথবা বিকল স্যাটেলাইট পৃথিবীর দিকে ঠেলে দেবেন, যাতে সেটি বায়ুমন্ডলের ঘর্ষণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ইঞ্জিনিয়াররা গবেষণাগারে বিকল স্যাটেলাইটের কাছে যাওয়ার পদ্ধতি পরীক্ষা করছেন। তবে কাছে যাওয়ার আগে তাদের এমন সব তথ্যের প্রয়োজন, যা শুধু ঘটনাস্থলে গিয়েই সংগ্রহ করা সম্ভব। পরিষ্কারের আগে এটাই প্রথম পদক্ষেপ। ডিএলআর-এর হাউকে ফিডলার বলেন, 'প্রথমে ছবি তুলে দেখতে হবে স্যাটেলাইট সোজা এগুচ্ছে, না-কি মাতালের মতো টলছে? সেটি কোন দিকে ঘুরছে? এবার হাত বাড়িয়ে সেটাকে ধরতে চাইলে জানতে হবে, ঠিক কোন অংশ ধরা যায় বা আদৌ ধরা সম্ভব কিনা! তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের নকশা পাওয়া যায় না।'
মহাকাশে কোনো কিছু ধরার পরীক্ষা চলছে। মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় রোবটের হাত সামান্য এদিক-ওদিক হলেই স্যাটেলাইট টলে যেতে পারে। এখানে সেই জটিল প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ইঞ্জিনিয়াররা কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারেন, পরীক্ষাও চালাতে পারেন। গোটা বিশ্বে অন্য কোথাও এমন উচ্চ পর্যায়ের গবেষণার সুযোগ নেই। প্রথমে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে রোবট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডিএলআর-এর জর্ডি আর্টিগাস বলেন, 'প্রথমে রোবটের হাত ও বিকল স্যাটেলাইটের মধ্যে যোগাযোগের তথ্য পৃথিবীতে পাঠানো হবে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে অপারেটর রোবটকে পরিচালনা করবেন। রোবটের মাধ্যমে মহাকাশে আবর্জনা বা জঞ্জাল পরিষ্কারের অভিযান শুরু হবে। তবে শর্ত হলো, যেসব দেশ বড় আকারের মহাকাশ অভিযান চালায়, তাদেরকে সেই ব্যয় বহন করতে হবে।'