এফএও ট্যাংক আইস বক্স কমাবে মাছের আহরণোত্তর ক্ষতি

প্রকাশ | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

তানিউল করিম জীম
মাছে-ভাতে বাঙালি এখন কেবল নামমাত্র। ঠিকমতো যত্নের অভাবে নষ্ট হয় অনেক মাছ। বাজারে আসতে আসতে পচন ধরে সিংহভাগ মাছে। মাছের পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে ও অপচয় কমাতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নওশাদ আলম নকশা করেছেন এফএও ট্যাংক আইস বক্স। দেশে বাক্সটি ব্যবহারে মাছের আহরণোত্তর ক্ষতি কমেছে প্রায় ১৮ ভাগ। আগে যেখানে মাছের আহরণোত্তর ক্ষতি ছিল ৩০ ভাগের কাছাকাছি, এখন এই বাক্স ব্যবহারে তা কমিয়ে ১২ ভাগে এসেছে। এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে ক্ষতির পরিমাণ আরও কমবে বলে মনে করেন গবেষক। এই প্রযুক্তি দেশ ছাড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। এফএও ট্যাংক আইস বক্স হচ্ছে স্থানীয়ভাবে তৈরি চমৎকারভাবে নকশা করা একটি কার্যকরী বরফ বাক্স, যার মাধ্যমে দেশের দূরদূরান্ত থেকে অনেক পরিমাণ মাছ এক সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে গুণগতমান অক্ষুণ্ন রেখে পরিবহণ করা হয়। আমাদের দেশে মাছের অন্যতম উৎস হলো নদী এবং সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ধরা মাছ। মাছ ধরার ওই সব ছোট-মাঝারি বা বড় নৌকাগুলোতে প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় মাছ। মাছ ধরার ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যেই মাছে পচন ধরতে শুরু করে। তাই মাছ ধরার পর পরই আইস বক্স ব্যবহার করলে মাছের গুণাগুণ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভালো থাকবে। ২০০০-২০০৫ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারে মৎস্য বিভাগ এবং জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পরিচালিত ইসিএফসি প্রকল্পের (বিজিডি/৯৭/০১৭) সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম নওশাদ আলমের উদ্ভাবিত এই বরফ বাক্সটি সাধারণত দীর্ঘ দূরত্বে বেশি পরিমাণ মাছ পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণা ২০০০ সালে শুরু হলেও এটি সম্প্রসারণ করতে সময় প্রায় ২০ বছর সময় লেগেছে বলে জানান গবেষক। গবেষক নওশাদ বাক্সটি সম্পর্কে বলেন, বর্তমানে এই এফএও ট্যাংক আইস বক্সটি দেশের অভ্যন্তরীণ মাছ পরিবহণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিআই সিট দিয়ে তৈরি ৩ দ্ধ ২.৫ দ্ধ ২ আকারের একটি বাক্স চারদিকে লোহার এঙ্গেল বার ও ফ্ল্যাট বারের ফ্রেমের ভিতর বসিয়ে ট্রাকে পরিবহণের উপযোগী করা হয়েছে। বাক্স তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে পেস্নইন সিট, অ্যাঙ্গেল, ফ্ল্যাট বার, শিকল, কাছি, কর্কসিট, আংটা, কব্জা, রং, রশি, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। জিআই সিট দিয়ে মোড়ানো কর্কসিটের বাক্সটি শক্ত ও টেকসই করার জন্য এর বাইরের দিকে একটি অ্যাঙ্গেল ও ফ্ল্যাট বারের তৈরি ফ্রেম বসিয়ে দেওয়া হয় যাতে ট্রাকে উঠানো নামানো ও পরিবহণের সময় বরফ বাক্স বা বাক্সের ভিতরের মাছ আঘাত না পায় বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রয়োজনের তাগিদে ও সুবিধামতো বাণিজ্যিক পরিবহণকারীরা ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়েছেন। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় ৩৬ দ্ধ ২৪ দ্ধ ২০ ইঞ্চি সাইজের বাক্স, আবার সাতক্ষীরা অঞ্চলে ৩৮ দ্ধ ২৮ দ্ধ ২৫ ইঞ্চি, ভৈরব অঞ্চলে ৩৬ দ্ধ ২৪ ী ২২ ইঞ্চি বা ২৪ দ্ধ ১৮ দ্ধ ১৮ ইঞ্চি সাইজের বাক্স ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় বাক্সে শীতকালে বরফ বাদে ২৫০-২৮০ কেজি এবং গরমকালে ২০০-২২০ কেজি মাছ পরিবহণ করা যায়। ছোট বাক্সে শীতকালে ১২০-১৫০ কেজি এবং গরমকালে ৮০-১২০ কেজি মাছ পরিবহণ করা হয়। বড় আকারের ভালো মানের ট্যাঙ্ক আইস বক্সের দাম ৭,০০০-৮,০০০/-। প্রয়োজন অনুযায়ী এর আকার পরিবর্তন করা যেতে পারে। ট্যাংক আইস বক্স ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত টেকসই হয়। গবেষক আরও জানান, দেশের প্রধান প্রধান অবতরণ কেন্দ্র, আড়ত বা মাছের বাজার থেকে বেশির ভাগ মাছ এভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর বা উত্তরবঙ্গে পরিবহণ করা হচ্ছে। ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী বা অন্যান্য মাছের আড়তে গেলে এই চিত্রটি সহজেই অনুধাবন করা যাবে। মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহণে ব্যবহৃত এই বরফ বাক্সগুলো তৈরির জন্য দেশব্যাপী অসংখ্য ছোট-বড় উদ্যোক্তা ও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ঢাকার রামপুরা, ধোলাইখাল, যাত্রাবাড়ী ও এখন কক্সবাজারের এন্ডারসন রোড, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে এই সব বরফ বাক্স তৈরি হচ্ছে। বহু বেকার লোকজন এতে আয়ের সাভার, গোপালগঞ্জ, পথ খুঁজে পেয়েছেন। মাছ ব্যবসায়ীরা বড় বাঁশের ঝুড়ি (৫-৬ মণ মাছ পরিবহণ করা হয়) ও এফএও ট্যাংক আইস বক্সের মধ্যে মাছ পরিবহণের তুলনামূলক ব্যয় হিসাব করে বের করেছেন। একটি বাঁশের ঝুড়ি মাত্র একবার ব্যবহার করা যায়।