মানবদেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংসকারী মরণব্যাধি এইডস

প্রকাশ | ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

শেখ একেএম জাকারিয়া
এ সময় সবচেয়ে বেশি আলোচিত মারাত্মক মরণব্যাধি হচ্ছে 'এইডস'। যার পূর্ণ নাম- 'এইডস' (অওউঝ = অপয়ঁরৎবফ ওসসঁহড় উবভরপরবহপু ঝুহফৎড়সব)। এটি একটি ঘাতকব্যাধি, যা এইচআইভি থেকে জন্ম নেয়। এই ভাইরাস মানবদেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়। এইচআইভি অন্যান্য ভাইরাসের মতো হলেও এর কার্যপদ্ধতি ভিন্ন। এখনো এই রোগের কোনো ভ্যাকসিন বা প্রতিরোধক উদ্ভাবিত হয়নি। এইচআইভি ভাইরাস সৃষ্ট ভয়াবহ এইডস রোগ ইপিডিমিক আকারে ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে এবং যারা এই রোগে মারা গেছে, তাদের প্রতি শোক পালন করতে 'পহেলা ডিসেম্বর' দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে। সরকারি ও স্বাস্থ্য আধিকারিকরা, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, বিশ্বে বিভিন্ন ব্যক্তি, এইডস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সবাইকে সচেতন করতে এই দিনটি পালন করে। বিশ্ব এইডস দিবসটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) দ্বারা চিহ্নিত, বিশ্ব জনস্বাস্থ্য সচেতনতার উদ্দেশ্যে ঘোষিত, আটটি বিশেষ দিবসের মধ্যে একটি। বাকি সাতটি দিবস হলো- বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস, বিশ্ব টিকা দিবস, বিশ্ব যক্ষ্ণা দিবস, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস এবং বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। ভাবনার বিষয় এই যে, বর্তমান বিশ্ব যেখানে কম্পিউটারের সাহায্যে বিশ্বব্যাপী উপাত্ত বিনিময়ের সংযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি বিজ্ঞানের আলোড়নে উচ্ছলিত, এইডস নামধেয় শঙ্কাজনক ব্যামোর বর্তমানতা সেখানে সভ্যতার ংঢ়ববফ নৎবধশবৎ। পৃথিবীর সব দেশেই আজ এইডসের বিদ্যমানতা লক্ষ্য করা যায়। ছোট-বড় সবাই বিদিত যে, এইডস হলে নিশ্চিত মৃতু্য। এইডস কী কারণে হয় এই সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নানারকম মত চলিত। দুঃখের কথা, এসব মতের বেশির ভাগই প্রলাপ। এইডস সম্পর্কে সমাজে অনেক ভ্রমযুক্ত বিশ্বাস বিরাজমান। এসব ভ্রমযুক্ত বিশ্বাস দূর করতে হলে সচেতনতা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন, যা কেবল শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব। এইডস এমন এক দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধি, যার নিরোধ আছে কিন্তু কোনো প্রতিবিধান নেই। এই ভাইরাস নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। ভাইরাস কী? কীভাবে ছড়ায়? কাদের কাছ থেকে ছড়ায় আরও কত কী! আদতে ভাইরাস হচ্ছে নিউক্লিক প্রোটিন দ্বারা গঠিত, অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী, সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ এক ধরনের জীবাণু, যা কিনা সুনির্দিষ্ট পোষক কোষে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে কেবল সেখানেই বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। মানবদেহের জন্য অনিষ্টকর, এমনকিছু ভাইরাস রোগের নাম হলো- ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও, এইডস, ক্যানসার, হার্পিস, বসন্ত, হাম, ভাইরাল হেপাটাইটিস ইত্যাদি। এইডস রোগের জীবাণু বা ভাইরাসের নাম হলো এইচআইভি। এইচআইভি এমন এক ধরনের রেট্রো ভাইরাস, যা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। ঐওঠ-এর পূর্ণরূপ হলো ঐঁসধহ ওসসঁহব উবভরপরবহপু ঠরৎঁং। পৃথিবীতে দুই ধরনের এইচআইভি পাওয়া গেছে। এগুলো হলো- ঐওঠ১, ঐওঠ২। এইডসের ইতিহাসে ভাইরাস দুটিকে মোটামুটি সেকেলেই ধরা যায়। উলেস্নখিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রতিটি মানুষের এইডস রোগের বিস্তার ও কারণ জানা অত্যন্ত জরুরি ও তাৎপর্যবহ। এইচআইভি ভাইরাস কিছু সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মানবদেহের ভেতর থাকা চার ধরনের তরল পদার্থের মাধ্যমে ছড়ায়। এগুলো হলো- রক্ত, বীর্য, যোনিরস ও মাতৃদুগ্ধ। এই চারটি তরল পদার্থ যদি কোনো এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে কোনো সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে, তবেই তিনি এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হলো- এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সংগম করা, এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করা, এইচআইভি বহনকারী মায়ের মাধ্যমে তার গর্ভস্থ সন্তান অথবা জন্মদানের সময় বা জন্মের পর দুগ্ধদানের মাধ্যমে সন্তান এইচআইভিতে আক্রান্ত হতে পারে, রক্তদানের সময় দানকৃত ব্যক্তির এইচআইভি থাকলে তা গ্রহণকারীর রক্তে সঞ্চালনের মাধ্যমে গ্রহীতার এইচআইভি হতে পারে। এ ছাড়া মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য সরাসরি দেহে প্রবেশ করায়, তাদের এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি অনিরাপদ যৌন মিলনের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়াতে এইচআইভি আক্রান্ত নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল ৫.৮ মিলিয়ন। একই অঞ্চলে ২০০০ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৭,০০,০০০ জন এইচআইভি আক্রান্ত ছিল। তাদের মধ্যে ৪,৫০,০০০ জন পুরুষ এবং ২,৫০,০০০ জন নারী। বর্তমানে এই অঞ্চলে ৭২ লাখ লোক এইচআইভিতে আক্রান্ত। যার মধ্যে ২০০২ সালেই ১০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু আক্রান্ত হয়েছিল। গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে অর্থাৎ সর্বদিক বিচারে এশিয়ার বর্তমান প্রেক্ষাপট খুবই দুঃখজনক। এদিকে আমাদের বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। যার পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং ভুটানে এইচআইভি সংক্রমণের হার পর্যায়ক্রমে বেড়েই চলছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এসব দেশের যোগাযোগ থাকার কারণে বাংলাদেশেও এইডসের বিস্তার ঘটছে। বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত দুটি জেলা সিলেট ও চট্টগ্রামে এইডসে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া সীমান্তে অবস্থিত জেলা যশোর ও রাজশাহীতেও এই হার চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের জন্য এই ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি থাইল্যান্ডের মতো হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জনসমাজ হলো যৌনকর্ম যাদের পেশা। ইনজেকশনের মাধ্যমে দেহে মাদক গ্রহণকারীরাও প্রাণঘাতী ঝুঁকিতে রয়েছে। এইডসে আক্রান্ত হওয়ার কিছু ঝুঁকিপূর্ণ জনসমাজ হলো- কিশোর ও তরুণ সমাজ, যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে। অল্প বয়স্ক মহিলা ও মেয়েশিশু, যাদের অর্ধেকের বেশি শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত। নিজের পরিবার, স্বজন ও সমাজ ছেড়ে আসা ভাসমান মানবসমাজ, যারা সচরাচরই একাকিত্বের কারণে যৌনকর্মীদের সঙ্গে রতিক্রিয়া করে থাকে। এ ছাড়া মাদকসেবী জনসমাজ, যারা অর্থের জন্য অনিরাপদ যৌনমিলনে বাধ্য হয়। এবার এইডসের লক্ষণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। এইডসের লক্ষণগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- মাঝেমধ্যে জ্বর, উদরাময়, মাথাব্যথা ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাস। মুখের ভেতর, ঠোঁটে ও জিভে সাদা পর্দা পড়া। মারাত্মক দুর্বলতা, হজমশক্তি ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস। শুকনা কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট। গ্রন্থিগুলো যেমন- গলা, বগল, ঊরু ও কোমরের সন্ধিস্থল ফুলে যাওয়া। রাতে ঘাম হওয়া, অনিদ্রা ও ওজন কমে যাওয়া। পিঠে, মুখে ও গলায় ফুসকুড়ি ইত্যাদি। মরণব্যাধি এইডসের কবল থেকে রক্ষা পেতে হলে এইডস প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি ও তাৎপর্যবহ। এইডস প্রতিরোধে মানবজাতির যা করতে হবে, তা নিম্নরূপ- ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। বিশেষত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিশ্বস্ততা বজায় রাখা। যৌন সম্পর্ক স্থাপনে নিরাপদ পদ্ধতি ব্যবহার করা। এ ছাড়া বহু নারীর সংস্পর্শে আসা ও গণিকালয়ে যাতায়াত বন্ধ করা। রক্তদানের পূর্বে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা। অন্যের সুই, সিরিঞ্জ, বেস্নড, রেজার, ক্ষুর ইত্যাদি ব্যবহার না করা। এইডস আক্রান্ত মায়ের গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকা। মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা এবং সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি অনলাইন-অফলাইন সব গণমাধ্যমে সতর্কতামূলক প্রচারণা চালানো।