শিল্পবিপস্নব ধারণাটির সাথে আমরা সবাই আজ কমবেশি পরিচিত। কারণ আমরা শিল্পবিপস্নবের ধাপ পার করেই আজকের যান্ত্রিক সভ্যতায় উপনীত হতে পেরেছি। কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে পালস্না দিয়ে আজ শিল্প তার স্থান দখল করে নিচ্ছে। কৃষিতেও যান্ত্রিকরণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাক শিল্পবিপস্নবের অর্থনীতি এবং শিল্প বিপস্নবের পরের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ভিন্ন। বলা যায়, শিল্প বিপস্নবের ফলে অর্থনীতির গতিতে জাদুকরী পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে মানুষের অভ্যাস ও রুচির ক্ষেত্রে। প্রথম শিল্পবিপস্নবের বহু যুগ পেরিয়ে আজ আমরা চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা শুধু সেই পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রথম শিল্প বিপস্নবের সূচনা হয়। কৃষি ও শিল্পে যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লাগে। প্রথম শিল্পবিপস্নবের পরেই বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের শুরু হয়। উৎপাদন ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনে মানুষের শিল্প উন্নয়নে পরিবর্তিত হয়। কৃষি থেকে শুরু করে কারখানার প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত ব্যাপক পরিবর্তন আসে। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত দ্বিতীয় শিল্পবিপস্নব ঘটে। মূলত বিদু্যৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে দ্বিতীয় শিল্পবিপস্নবের যুগে প্রবেশ করি এবং ১৯৬০-এর দশক থেকে তৃতীয় শিল্পবিপস্নব শুরু হয়। প্রথমে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার যোগাযোগ ক্ষেত্রে প্রভুত উন্নয়ন সাধনের পর ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হলে শিল্পবিপস্নব পরিপূর্ণ গতি লাভ করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমেই সহজ হয়ে ওঠে। বিশ্বের দূরবর্তী দেশসমূহকে কাছে নিয়ে আসে। ক্রমেই উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পুরোপুরি যান্ত্রিকীকরণের রূপ লাভ করে। বর্তমানে বিশ্ব একটি গেস্নাবাল ভিলেজ বা বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। এক দেশের সাথে অন্য দেশের সম্পর্ক এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগও সহজ হয়েছে। প্রযুক্তিগত কারণে বিশ্বের জনসংখ্যা মাত্রারিক্ত হলেও উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের ফলে খাদ্য উৎপদনে ঘাটতি না হয়ে তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা আজ নিজেদের প্রস্তুত করছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তার ব্যবহারে শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, উৎপাদন ব্যবস্থা, যোগাযোগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিজেদের চতুর্থ বিপস্নবের পরিবর্তনে উপযোগী করে তোলা। প্রযুক্তিকেই আধুনিকায়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। হাতে হাতে এন্ড্রয়েট চালিত মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট, ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কাজের ক্ষেত্রে মানুষের পরিবর্তে রোবটের ব্যবহার, জিন প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং- এসব কিছু মিলিয়েই চতুর্থ শিল্পবিপস্নব। আমরা আজ এই পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামনে। খুব দ্রম্নতই এসব পরিবর্তন ঘটছে। শিল্প ক্ষেত্রে মানুষের স্থলে রোবটের ব্যবহার শুরু হচ্ছে। দেশে মেধাবীরা রোবট নিয়ে গবেষণা করছে। মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় সেসব রোবটের ছবি ছাপা হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব প্রতিনিয়ত এসব আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছে। আমরাও বসে থাকতে পারি না। পত্রিকার পাতায় মাঝে মধ্যেই সেসব রোবটের খবর দেখতে পাই। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের প্রস্তুতির। চতুর্থ শিল্পবিপস্নব নিয়ে আমরা কী ভাবছি বা কীভাবে এই পরিবর্তনে নিজেদের সামিল করতে পারব সেই আলোচনা চলছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। এই উন্নয়নের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসবে। কিন্তু যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে একটি প্রস্তুতির প্রয়োজন। অন্যান্য শিল্পবিপস্নবের সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপস্নব শুধু মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে যন্ত্র ও প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে দ্রম্নততর করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপস্নব শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমকে আরও বেশি গতিশীল ও নিখুঁত করে তুলছে। ইউকেভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিডবিস্নউসি'র তথ্যমতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি মানুষ তাদের বর্তমান চাকরি হারিয়ে ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট চাকরিজীবীর মধ্যে ৩৮.৪৭%, যুক্তরাজ্যে ৩০%, জাপানে ২১% এবং জার্মানির ৩৫% লোকের চাকরি হারানোর প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিং এবং স্মার্ট অটোমেশন নির্ভর চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের ফলে।
নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। আমাদের লক্ষ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হলে চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের প্রযুক্তিগত সুবিধার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। এর অংশ হিসেবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ শুরু হবে ২০২০ অর্থাৎ চলতি বছর থেকেই। এই পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ অব্যাহত রাখার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার চার বছর পার হচ্ছে। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্যতার হার শূন্যে নামিয়ে আনা, দেশকে ক্ষুধামুক্ত করা, সাশ্রয়ী বিদু্যৎ জ্বালানি সুবিধা, বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি লক্ষ্য পূরণ করা আবশ্যক। সরকার এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর থেকে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের মূল ধাক্কা যাবে আমাদের চাকরি খাতে বলে মনে করা হয়। প্রযুক্তির দ্রম্নত অগ্রগতির কারণে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষের ছোঁয়ার পরিবর্তে সেসব স্থানে রোবটের দেখা পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যতে এই হার আরও বৃদ্ধি পাবে। মূলত চাকরির বাজারে এবং এর ধরনে একটি পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠা কঠিন হবে। বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ সভা-সেমিনারে এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান এবং সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। গত বছরের অক্টোবরে চট্টগ্রাম নগরীতে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে চতুর্থ শিল্পবিপস্নব হলে কী পরিবর্তন আসতে পারে, চাকরির ক্ষেত্রে কতটুকু পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে প্রেজেন্টেশনে উঠে আসে যে, চতুর্থ শিল্পবিপস্নব হলে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে। কারণ গতানুগতিক কাজগুলো করবে রোবট বা মেশিন। ফলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি সামাল দিতে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
তবে সম্প্রতি এই ধারণা পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, রোবটের কারণে ২০২২ সাল নাগাদ কাজ হারাবে ৭ কোটি মানুষ। কিন্তু এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ ঐ একই সময়ে নতুন প্রযুক্তির কারণে তৈরি হবে ১৩ কোটি ৩০ লাখ কাজ। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষের সময় বেঁচে যাবে অনেক, আর সেটা তাদের অন্য কাজ করার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু সমালোচকরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, যেসব কাজ চলে যাবে, তার জায়গায় যে নতুন চাকরি তৈরি হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাদের রিপোর্টটিতে বলা হচ্ছে, রোবট এবং এলগরিদমের কারণে এখনকার বিভিন্ন কাজের উৎপাদনশীলতা অনেকগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু এর ফলে নতুন কাজ তৈরিরও সুযোগ হবে। অর্থাৎ বিষয়টা এমন যে, প্রযুক্তির কারণে আমাদের যদি কর্মসংস্থানের ভারসাম্যে প্রভাব পড়ে, তার সমাধানও আছে এই প্রযুক্তিতেই। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম চতুর্থ শিল্পবিপস্নব মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থা হবে আরও দ্রম্নততর। শিল্পোন্নত দেশগুলো দ্রম্নত থেকে দ্রম্নততর যান তৈরিতে ব্যস্ত। সড়ক, আকাশ, নৌ এবং রেলপথ সব দিকে গতি প্রাধান্য পাচ্ছে। প্রাত্যহিক জীবনের কর্মকান্ড হবে আরও সহজতর। প্রযুক্তির ব্যবহার আপনাকে সেই সুবিধা দেবে। শুধু নিজেকে প্রস্তুত করার কাজটুকু করতে হবে। আমরা বেশ দ্রম্নতগতিতেই এগিয়ে চলেছি। প্রযুক্তির ব্যবহার ইতিমধ্যেই প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি। দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। দেশের ফোর-জি ইন্টারনেট প্রযুক্তি আজ শিক্ষা বিস্তারসহ তথ্যমূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের যোগাযোগব্যবস্থা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ আজ মহাকাশে। আমরা এখন ফাইভ-জি ইন্টারনেট প্রযুক্তি এসেছে এবং দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের অপেক্ষায়। গড়ে উঠেছে হাইটেক পার্ক, যা প্রযুক্তি এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চতুর্থ শিল্পবিপস্নবকে কাজে লাগাতে হলে সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। সেজন্য দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে হবে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এই কর্মসংস্থান হবে প্রযুক্তিনির্ভর। বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের যুগে প্রবেশ করতে চায় এবং নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে যায়। একসময় বাইরের দেশের প্রযুক্তি পণ্যেই ব্যবহার করা হতো। আজ দেশের পণ্য দেশে ব্যবহার হয়েও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। মোট কথা, চতুর্থ শিল্প বিপস্নবের যুগে আমরা আমাদের দক্ষতা নিয়েই প্রবেশ করব এবং পুরো সুবিধা কাজে লাগাতে নিজেদের দক্ষ করে তুলব।