শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

ফয়েলে তৈরি গ্রিনহাউসের ছাদ

সাধারণ কাচ দিয়ে তার ছাদ তৈরি করা যেত না। একাধিক ফয়েলের স্তর দিয়ে এ ছাদ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি স্তরের মধ্যেই রয়েছে ফাঁকা জায়গা। ফলে হলের ভেতরের তাপমাত্রা ও পরিবেশ সহজেই অটুট থাকে। বাইরের পরিবেশে যেসব গাছপালা বা প্রাণীর টিকে থাকার কথা নয়, দেখা গেছে আলট্রাভায়োলেট রশ্মির কল্যাণে আদর্শ পরিবেশ পেয়ে তারা ভালোভাবেই বেঁচে আছে। আধুনিক স্থাপত্যকলায় পস্নাস্টিক ফয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিপস্নব এনে দিয়েছে অলিম্পিকের এই সাঁতার স্টেডিয়াম। বেলুনের মতো দেখতে এ অংশগুলোই এমন কাঠামোর বৈশিষ্ট্য। শুধু ভেতরের তাপমাত্রা স্থির রাখা নয়, স্থিতিশীলতার জন্যও এটি জরুরি
প্রদীপ সাহা
  ১০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ফয়েলে তৈরি গ্রিনহাউসের ছাদ

মহাকাশ পেরিয়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ভেতর দিয়ে এসে সূর্যের আলো পৃথিবীকে উত্তপ্ত করলেও এর অনেকটা বিকিরিত হয়ে আবার মহাশূন্যে ফিরে যায়। এজন্য পৃথিবী খুব একটা উত্তপ্ত হতে পারে না। কিন্তু বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে এরূপ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে না। পৃথিবীর তাপ মহাশূন্যে বিকিরিত হওয়ার পথে বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড কিছুটা তাপ ধরে রাখে। তাই বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আর তখন পৃথিবীর তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রিনহাউসের কাঁচের দেয়ালের মতো কাজ করে বলে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির এ ঘটনাকে নাম দিয়েছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া। শীতপ্রধান দেশগুলোতে সূর্যের আলোকে সংরক্ষণ করতে এবং গাছের চারা উৎপাদনের জন্য ব্যবহার হয় গ্রিনহাউস বা কাচের ঘর। তবে এ পদ্ধতিতে পৃথিবীর তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সূর্যালোক থেকে দিনের বেলা তাপ আসবে এবং রাতের বেলা বিকিরিত হয়ে চলে যাবে- এটাই নিয়ম। কিন্তু কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন ও ক্লোরোফ্লোরোকার্বন ইত্যাদি গ্যাস কাচের মতো আটকে ফেলে সূর্যের তাপ। পৃথিবীতে আসা সূর্যের তাপের একটা অংশ বিকিরণ হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। দিন দিন বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রাও। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জমাটকৃত বরফ দিন দিন গলে সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জার্মানে গ্রিনহাউসের জন্য তৈরি হয়েছে এক প্রযুক্তি। ধরুন, বাইরে বরফ অথচ গ্রিনহাউসে ফলছে আম-কাঁঠাল; শীতের দেশে চিড়িয়াখানা, কিন্তু ভেতরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঘ-সিংহ। ভাবছেন এসব কীভাবে সম্ভব! আদৌ কি সম্ভব এই অসাধ্যকে সাধন করা! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই অসম্ভবকে সহজেই সম্ভব করে তুলেছে পস্নাস্টিকের তৈরি এক বিশেষ ফয়েল। এই ফয়েল দ্বারা জার্মানির উত্তরে ব্রেমেন শহরে এক পার্কে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গল গড়ে উঠেছে। সাধারণত শুধুমাত্র হিমালয় পর্বত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এমন গাছপালা দেখা যায়। তবে এগুলো দিব্যি বেড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক রহস্য। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রিনহাউসের ছাদ। এটি ঢাকা হয়েছে 'ইটিএফই' নামের ফ্লুয়োরিনভিত্তিক বিশেষ ধরনের এক পস্নাস্টিক দিয়ে। আর তাতেই এই অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব হয়েছে।

ব্রেমেন শহরের পরিবেশ দপ্তরের প্রতিনিধি মিশায়েল ভ্যারবেক জানান, 'আমরা চেয়েছিলাম, এসব গাছপালা যতটা সম্ভব সূর্যের আলো পাক। মাঝে মাঝে আমরাও বুঝতে পারি যে, বেশিক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে ত্বকে ফোসকা পড়ে। কিন্তু গাছপালার জন্য এ আলো খুবই ভালো। সাধারণ কাচের মধ্য দিয়ে সেই আলট্রাভায়োলেট বা অতি-বেগুনি রশ্মি ভালো করে ঢোকে না। তারপর লক্ষ করলাম, ফয়েলের মধ্য দিয়ে সেই রশ্মি দিব্যি ঢুকে যায়।' ইটিএফই দিয়ে তৈরি এই ফয়েল সত্যি অসাধারণ। এটি কাচের মতো অতি-বেগুনি রশ্মি আটকে দেয় না। ফলে এমন ছাদের নিচে গাছপালা ভালোভাবেই বেড়ে ওঠে; অন্য ধরনের ফয়েল তা পারে না। ফ্লুয়োরিনভিত্তিক পস্নাস্টিক বা ইটিএফই দিয়ে তৈরি ফয়েল দেখতে রান্নাঘরের নন-স্টিক প্যানের মতো- চর্বি, তেল অথবা ময়লা এর গায়ে লাগে না। তাছাড়া ফ্লুয়োরিনভিত্তিক পস্নাস্টিক বা ইটিএফই দিয়ে তৈরি এই ফয়েল খুবই হালকা। জার্মানের লাইপসিশ শহরের চিড়িয়াখানায় গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামের যে বিশাল হল রয়েছে, সাধারণ কাচ দিয়ে তার ছাদ তৈরি করা যেত না। একাধিক ফয়েলের স্তর দিয়ে এ ছাদ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি স্তরের মধ্যেই রয়েছে ফাঁকা জায়গা। ফলে হলের ভেতরের তাপমাত্রা ও পরিবেশ সহজেই অটুট থাকে। বাইরের পরিবেশে যেসব গাছপালা বা প্রাণীর টিকে থাকার কথা নয়, দেখা গেছে আলট্রাভায়োলেট রশ্মির কল্যাণে আদর্শ পরিবেশ পেয়ে তারা ভালোভাবেই বেঁচে আছে। ইটিএফই ফয়েলের আরও সুবিধা হলো, এর সাহায্যে বেশ অদ্ভুত ধরনের ছাদ বা দেয়াল তৈরি করা যায়। কাচের চেয়ে এই ফয়েল ব্যবহারের খরচও কম।

প্রকৃতির মধ্যে যেসব জ্যামিতিক রূপ দেখা যায়, সেগুলো অনেক সময় প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। সাবান দিয়ে তৈরি বুদবুদের মতো আকৃতি এর একটা ভালো উদাহরণ। বুদবুদের আকারে তৈরি সবচেয়ে বিখ্যাত ভবন রয়েছে চীনের বেইজিংয়ে। আধুনিক স্থাপত্যকলায় পস্নাস্টিক ফয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিপস্নব এনে দিয়েছে অলিম্পিকের এই সাঁতার স্টেডিয়াম। বেলুনের মতো দেখতে এ অংশগুলোই এমন কাঠামোর বৈশিষ্ট্য। শুধু ভেতরের তাপমাত্রা স্থির রাখা নয়, স্থিতিশীলতার জন্যও এটি জরুরি। এতে পাম্প দিয়ে বাতাসের সঠিক চাপ বজায় রাখা হয়। গাছপালার জন্য অতি-বেগুনি রশ্মি প্রয়োজনীয় হলেও এর মাত্রা বেশি হলে মানুষের ক্ষতি হতে পারে। ব্রাজিলের এক বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামে এই ফয়েল তার একটা সুরাহা করেছে। গোল গোল নকশা সূর্যের রশ্মির তাপ কমিয়ে দেয়। নন-স্টিক প্যানের মতো এই ফয়েল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে এর গায়ে কিছুই লেগে না থাকে। তবে ইটিএফই নামের ফ্লুয়োরিনভিত্তিক বিশেষ ধরনের পস্নাস্টিক দিয়ে তৈরি এই ফয়েলের মাধ্যমে গ্রিনহাউসের ছাদ তৈরি করা সম্ভব হলেও এর একটি সমস্যা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাচের তুলনায় ইটিএফই'র একটি দোষ রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, এটি তেমন স্বচ্ছ নয়। তবে এতে সেই গুণ নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। ফয়েলে তৈরি গ্রিনহাউসের এ ছাদ সত্যি কতটুকু অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, তা দেখার প্রত্যাশায় বিশ্ববাসী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে