জেনেটিক্স ও ক্লোনিং : বিজ্ঞানের দুর্দান্ত বিস্ময়
জেনেটিক্স ও ক্লোনিং বিজ্ঞানের দুটি চাঞ্চল্যকর শাখা। জেনেটিক্স এমনকি মানুষকে প্রায় অমরত্বের দ্বারে পৌঁছে দিতে পারে। গড়তে পারে জীবনঘাতী রোগ বা লিথাল ডিজিজ মুক্ত পৃথিবী। অনেক মেধা ও সম্ভাবনার অধিকারী এই মানুষের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার স্বল্পায়ু এবং নানা মারাত্মক রোগ, ব্যাধি। মানুষ ও পশুপাখি এবং গাছপালার জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটনের মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের আয়ুস্কালকে বৃদ্ধি করতে পারে, তেমন বিভিন্ন রোগব্যাধি মুক্ত পৃথিবী গড়তে পারে
প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
সাগর আহমেদ
বিজ্ঞান আজ তার বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় একবিংশ শতাব্দীতে দুর্দান্ত অগ্রগতি সাধন করেছে। মহাকাশ বিজ্ঞান বা কসমোলজি, আ্যরোনটিক্স, ওসেনোগ্রাফি, মেডিকেল সায়েন্স ইত্যাদি বিভিন্ন শাখায় বিজ্ঞান তড়িৎ গতিতে এগিয়ে চলছে, হচ্ছে নিত্য নতুন যুগান্তকারী আবিষ্কার। তবে মানুষের দেহকোষ ও ডিএনএ নিয়ে যে গবেষণা চলছে, তা মানুষের মনে জাগাচ্ছে অকল্পনীয় সব সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রে জেনেটিক্স ও ক্লোনিং বিজ্ঞানের দুটি চাঞ্চল্যকর শাখা। জেনেটিক্স এমনকি মানুষকে প্রায় অমরত্বের দ্বারে পৌঁছে দিতে পারে। গড়তে পারে জীবনঘাতী রোগ বা লিথাল ডিজিজ মুক্ত পৃথিবী। অনেক মেধা ও সম্ভাবনার অধিকারী এই মানুষের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার স্বল্পায়ু এবং নানা মারাত্মক রোগ, ব্যাধি। মানুষ ও পশুপাখি এবং গাছপালার জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটনের মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের আয়ুস্কালকে বৃদ্ধি করতে পারে, তেমন বিভিন্ন রোগব্যাধি মুক্ত পৃথিবী গড়তে পারে। কিভাবে? যেমন মানুষের ক্যান্সার রোগের কথাই ধরা যাক, এই রোগে মানুষের কোষের সৃষ্টি ও ধ্বংসের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রয়েছে তার ধারাবাহিকতা বা চেইন ভেঙে পরে। জেনেটিক্সের প্রায়োগিক ব্যবহারে নতুন কোষ সৃষ্টির মাধ্যমে এই ধারাবাহিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্যানসার রোগ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব। এছাড়া জেনেটিক্স গবেষণায় মাধ্যমে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর নষ্ট হয়ে যাওয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নতুন করে তৈরি করা সম্ভব। এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা দ্রম্নত গতিতে এগিয়ে চলছে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন মানুষের হাত,পা, হৃদপিন্ড ইত্যাদি অঙ্গ কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেলে জেনেটিক্সের যাদুর ছোঁয়ায় তা আবার নতুন করে ফিরে পাওয়া যাবে। ইদানীং জেনেটিক্সের স্টেমসেল চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্ষয়ে যাওয়া হাড় বা অস্তির মেরামত সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্স বা জীবন রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধ উপযোগী করে তোলা হচ্ছে, করা হচ্ছে রোগ,ব্যাধি মুক্ত। এভাবে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষিক্ষেত্রে জিনেটিক্স যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ববিখ্যাত রিডার্স ডাইজেস্টে দেখেছি একটি ইঁদুরের পিঠে মানুষের কান স্থাপিত হওয়ার এক অসাধারণ দৃশ্য। এটি জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণার এক বিরাট অগ্রগতির সাক্ষর বহন করছে। জেনেটিক্সের সঙ্গা যদি আমরা জানতে চাই তবে সাদামাটা কথায় জেনেটিক্স হলো জিন, জিনগত বিবর্তন, বংশগতির ডিএনএ চক্রের একটি বিস্তারিত আলোচনা। এটিকে বংশগতি ও বিবর্তণবিদ্যার একটি সংমিশ্রণ ও বলা যায়। জেনেটিক্স আলাদিনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ যা একদিন মানুষকে দিতে পারে হাজার হাজার বছরের পরমায়ু, বিশাল ও টেকসই খাদ্য ভান্ডার এবং রোগ ব্যাধি মুক্ত সুখী জীবনের অনন্য সন্ধান।
জেনেটিক্স হল জীবের মধ্যে জিন, জেনেটিক বৈচিত্র্য এবং বংশগতির অধ্যয়ন। এটি জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা কারণ বংশগতি জীবের বিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গ্রেগর মেন্ডেল, একজন মোরাভিয়ান অগাস্টিনিয়ান ফ্রিয়ার যিনি ১৯ শতকে ব্রনোতে কাজ করেছিলেন, তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে জেনেটিক্স শাস্ত্রের সূচনা করেছিলেন। মেন্ডেল 'বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার' অধ্যয়ন করেছিলেন, সময়ের সাথে সাথে পিতামাতার কাছ থেকে সন্তানদের কাছে যেভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো হস্তান্তর করা হয় তার নিদর্শন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে জীবগুলো (মটর গাছ) পৃথক 'উত্তরাধিকারের একক' পদ্ধতিতে বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। এই শব্দটি, আজও ব্যবহৃত হয়, এটি একটি জিন হিসাবে উলেস্নখ করা একটি কিছুটা অস্পষ্ট সংজ্ঞা।
জিনের বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার এবং আণবিক উত্তরাধিকার প্রক্রিয়াগুলো এখনও ২১ শতকে জেনেটিক্সের প্রাথমিক নীতি, কিন্তু আধুনিক জেনেটিক্স জিনের কার্যকারিতা এবং আচরণ অধ্যয়নের জন্য প্রসারিত হয়েছে। জিনের গঠন এবং কার্যকারিতা, প্রকরণ এবং বন্টন কোষ, জীবের প্রেক্ষাপটে (যেমন আধিপত্য) এবং জনসংখ্যার প্রেক্ষাপটে অধ্যয়ন করা হয়। জেনেটিক্স আণবিক জেনেটিক্স, এপিজেনেটিক্স এবং জনসংখ্যা জেনেটিক্সসহ বেশ কয়েকটি উপক্ষেত্রের জন্ম দিয়েছে। বিস্তৃত ক্ষেত্রের মধ্যে অধ্যয়ন করা জীবগুলো জীবনের ডোমেনগুলোকে বিস্তৃত করে (আর্কিয়া, ব্যাকটেরিয়া এবং ইউক্যারিয়া)।
জেনেটিক প্রক্রিয়াগুলো একটি জীবের পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতার সাথে সমন্বয়ে কাজ করে যা বিকাশ এবং আচরণকে প্রভাবিত করে, প্রায়শই প্রকৃতি বনাম লালন হিসেবে উলেস্নখ করা হয়। জীবিত কোষ বা জীবের অন্তঃকোষীয় বা বহির্কোষী পরিবেশ জিন প্রতিলিপি বৃদ্ধি বা হ্রাস করতে পারে। একটি ক্লাসিক উদাহরণ হল জিনগতভাবে অভিন্ন ভুট্টার দুটি বীজ, একটি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে এবং একটি শুষ্ক জলবায়ুতে (পর্যাপ্ত জলপ্রপাত বা বৃষ্টিপাতের অভাব)। যদিও দুটি ভুট্টার ডালপালাগুলোর গড় উচ্চতা জেনেটিক্যালি সমান বলে নির্ধারিত হতে পারে, তবে শুষ্ক জলবায়ুতে জল এবং পুষ্টির অভাবের কারণে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে একটির উচ্চতার অর্ধেক পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি জাপানে জেনেটিক্স মোডিফিকেশন গবেষণায়
মানুষ ও অন্য প্রাণী যেমন ঘোড়া, বাঘ, সিংহ ইত্যাদির সংমিশ্রণে নতুন প্রাণী সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। ওই যে আমরা রূপকথায় পড়েছি মৎস্যমানবী বা মারমেইডের কথা, ঘোড়া মানব বা সেন্টোরের কথা, সেই রূপকথার রাজ্যের যেনো আমাদের মাঝে সত্যি হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এবার আসি বিজ্ঞানের আরেকটি শাখা ক্লোন শাস্ত্র নিয়ে। ক্লোনিং সিস্টেম হলো কোষ গবেষণার আরেকটি বিস্ময়কর রূপ। এক্ষেত্রে এটি হলো মানুষ সহ বিভিন্ন প্রাণীর জনন কোষকে ব্যবহার না করে শুধুমাত্র দেহকোষ বিশ্লেষণ এবং বিবর্ধনের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রাণী ও উদ্ভিদ কৃত্রিমভাবে জন্মানোর একটি প্রকৃয়া। এই ক্লোন পদ্ধতিতে শুধুমাত্র একটি জীবের দেহকোষ বিশ্লেষণ ও বিবর্ধণের মাধ্যমে নতুন জীব সৃষ্টি করা হয়। মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর একজন সদস্যের দেহকোষ সংগ্রহ করে হুবহু তার মতো দেখতে এবং তার মতো বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীব তৈরি করা হয়। যেমন ধরুন মিস্টার এক্সের দেহকোষ ক্লোন করে যে নতুন মানুষটি পাওয়া যাবে তা হবে মিস্টার এক্সের হুবহু প্রতিরূপ। একই রকম দেখতে, একই রকম স্বভাব, একই রকম আচরণ, কি আশ্চর্য ! কি আশ্চর্য!! তবে এই পদ্ধতিতে সৃষ্ট প্রতিরূপ সন্তানের রোগ ব্যাধি প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে।
হয়তো বা আরো গবেষণা হলে এ সমস্যাটি থাকবে না।
এ পদ্ধতিতে সন্তান উৎপাদনে স্বামী, স্ত্রী লাগে না, কেবল একজন হলেই হয়। প্রচলিত বিয়ে শাদি, ঘর সংসার, সেক্স ইত্যাদির স্বতঃসিদ্ধ ধারণাটিই যেনো ক্লোন শাস্ত্র টলিয়ে দিতে চাইছে। তবে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ক্লোন গবেষণায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে ডুপিস্নকেট মানুষ সৃষ্টির আশঙ্কায়। তবে এই ক্লোন শাস্ত্র যে বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জেনেটিক্স ও ক্লোনিংয়ের ভালো দিকগুলোকে কাজে লাগিয়ে মানবজাতি উপকৃত হবে, দীর্ঘায়ু হবে, বিজ্ঞানের রহস্যময় কড়িডোরে আরো বহুধাপ এগিয়ে যাবে, এই আমাদের প্রত্যাশা রইল।