ইলেকট্রনিক্স বিদ্যা এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রান্সমিটার হলো এমন একটি যন্ত্র যা তড়িৎ প্রবাহকে ব্যবহার করে বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন করে। যখন একটি অ্যান্টেনা এটার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে তখন অ্যান্টেনাও বেতার তরঙ্গ নির্গত করে।
কেবল সম্প্রচার ছাড়াও ট্রান্সমিটার আরও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে আছে মোবাইল টেলিফোন, ওয়্যারলেস কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, বস্নুটুথ প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্র, গ্যারেজের দরজা খোলার রিমোট, বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা রেডিও, সমুদ্রগামী জাহাজ, মহাকাশযান, রাডার এবং দূরবর্তী চিহ্ন শনাক্তকারী বিকন ইত্যাদি। 'ট্রান্সমিটার' শব্দটি কেবল ব্যবহৃত হয় এমন যন্ত্রপাতিতে যেখানে বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন করা হয় যোগাযোগের উদ্দেশ্যে বা যেখানে রেডিও লোকেশন প্রযুক্তির ব্যবহার আছে। অন্যকোনো উদ্দেশ্যে কৃত্তিমভাবে রেডিও তরঙ্গ উৎপন্ন করা হলে, যদি সেখানে যোগাযোগের প্রয়োজন না থাকে তাহলে তাকে ট্রান্সমিটার বলা যায় না।
সম্প্রচার কার্যে ব্যবহৃত ট্রান্সমিটারকে বিশেষভাবে ব্রডকাস্ট ট্রান্সমিটারই বলা হয়ে থাকে যেমন বাণিজ্যিক এফএম রেডিও চ্যানেল কিংবা টিভিতে যেগুলো ব্যবহার করা হয়। ব্রডকাস্ট ট্রান্সমিটার বলতে ট্রান্সমিটার, অ্যান্টেনা, টাওয়ারসহ পুরো সেটআপটাকেই একসঙ্গে সম্প্রচার ট্রান্সমিটার বলে।
ট্রান্সমিটারকে তুলনামূলক অপ্রাসঙ্গিক একটা টার্মেও ব্যবহার করা হয়। টেলিমেট্রি সার্ভিসে ট্রান্সমিটার হলো এমন একটি যন্ত্র বা প্রযুক্তি যেটাকে ব্যবহার করে দৃশ্যমান কোনো বস্তুকে সেন্সরের সাহায্যে সিগনালে পরিবর্তন করা যায় এবং দূরবর্তী কোনো জায়গায় বিশেষ রিসেপশন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সিগনাল রিসিভ করে পর্দায় তা দেখা যায়।
একটি ট্রান্সমিটার যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র বা বর্তনী থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আলাদা একটি যন্ত্র হিসেবে থাকতে পারে। ট্রান্সমিটার এবং রিসিভারকে একত্র করে ট্রান্সিভার নামে ডাকা হয়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রায়ই ট্রান্সমিটারকে এক্সএমটিআর বা টিএক্স লেখা হয়। রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রান্সমিটারের কাজই হলো দূরবর্তী জায়গায় সিগনাল বা সংকেতকে পৌঁছে দেওয়া। ট্রান্সমিটারকে যে কোনো প্রকার তথ্যকেই ইলেকট্রনিক সিগনালে রূপান্তর করে দেওয়া হয় যেমন- অডিও বা ভয়েস/সাউন্ডের ক্ষেত্রে মাইক্রোফোন ব্যবহার করে, ভিডিওর ক্ষেত্রে ক্যামেরার লেন্সকে ব্যবহার করে আবার ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ডিভাইসে কম্পিউটারের ডিজিটাল সিগনালের মাধ্যমে। বিভিন্ন ক্ষেত্র বা মাধ্যমে থেকে পাওয়া এসব সিগনালকে তারপর ট্রান্সমিটার একীভূত করে এবং রেডিও তরঙ্গতে পরিবর্তন করে বেতার তরঙ্গ বিকিরণ করে, যাকে ক্যারিয়ার সিগনাল বলা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটাকেই বলা হয় 'মডুলেশন'। বিভিন্ন রকম ট্রান্সমিটারে বিভিন্নভাবে তথ্য প্রক্রিয়া করা হয়। অ্যামপিস্নচু্যড মডুলেশনে (এম), রেডিও সিগনাল বাড়িয়ে কমিয়ে অ্যামিপিস্নচু্যড করে তথ্য প্রক্রিয়া করে প্রেরণ করা হয়। ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশনে (এফএম), বেতার বর্ণালির রেডিও তরঙ্গকে বাড়িয়ে কমিয়ে তথ্য প্রেরণ করা হয়। এর বাইরেও বহু পদের মডুলেশন আছে।
বহনযোগ্য যন্ত্রপাতি যেমন- মোবাইল ফোনে, ওয়াকি-টকিতে বা গ্যারেজের দরজা খোলার রিমোটের ভেতর ব্যবহৃত ট্রান্সমিটারে অ্যান্টেনা অবশ্যই থাকে। কখনো কখনো ভেতরে আবার কখনো বাইরেও দৃশ্যমান হয়। ট্রান্সমিটার যত শক্তিশালী হবে, অ্যান্টেনা তখন উঁচু ভবনের ছাদে বা সম্পূর্ণ আলাদা একটি টাওয়ার বানিয়ে ফিড লাইন অর্থাৎ ট্রান্সমিশন কেবলের মাধ্যমে ট্রান্সমিটারের সঙ্গে যুক্ত হবে।
ইতিহাস : ১৮৮৭ সালে জার্মান পদার্থবিদ হেনরিক হার্টজ বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণার সময় প্রাথমিক ট্রান্সমিটার তৈরি করেন যাকে 'হার্জের অস্কিলেটর' বলা হতো। দুটো পরিবাহী কন্ডাক্টরের মধ্যে বৈদু্যতিক স্ফুলিঙ্গ আদান-প্রদানের মাধ্যমে এটা কাজ করত। ১৮৯৫ সালে, স্পার্ক ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে মার্কোনি সর্বপ্রথম বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করেন। ১৯২০ সালের দিকে দুটি ট্রান্সমিটার পদ্ধতি বাজারে আসে। একটির নাম আলেক্সেন্ডারসন অল্টারনেটর এবং আরেকটির নাম পওলসন আর্কট্রান্সমিটার, দুটোই ছিল প্রথম যুগের কন্টিনিউয়াস ওয়েভ ট্রান্সমিটার। এগুলো ১৯১২ সালে আবিষ্কৃৃত অ্যাডওয়ার্ড আর্মস্ট্রং এবং আলেক্সান্ডার মেসনারের যৌথ গবেষণার ফসল 'ফিডব্যাক অস্কিলেটর' ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল। মূলত এফএম রেডিও আবিষ্কার হয় ১৯৩৩ সালে এডউইন আর্মস্ট্রং কর্তৃক। ১৯২০ সালের শেষদিক থেকে পরীক্ষামূলক টিভি সম্প্রচারেরও চেষ্টা করা হয়, যদিও সত্যিকারের সফল টেলিভিশন সম্প্রচারণ শুরু করতে করতে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাডারের ব্যবহার ছিল ইউএইচএফ এবং মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে হাই ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সমিটারের সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য অবদান এবং আরও বেশ কিছু নতুন নতুন যন্ত্রপাতি যার মধ্যে ছিল : ম্যাগনেট্রন, ক্লিসট্রন এবং ওয়েভ টিউব। ট্রানজিস্টারের আবিষ্কারের পরে ১৯৬০-এর দিকে ছোট বহনযোগ্য ট্রান্সমিটারের আবির্ভাব হয়। যেমন- তারবিহীন মাইক্রোফোন, ওয়াকি-টকি ইত্যাদি। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারিদের ব্যবহৃত ওয়াকি-টকি ছিল মূলত ভ্যাকুয়াম টিউবনির্ভর। বর্তমান যুগে, রেডিও বর্ণালিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন রেঞ্জের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করার জন্য উপযোগী করে ভিন্ন ধরনের ট্রান্সমিটার তৈরি করা হয়েছে যা স্প্রেড স্পেকট্রাম অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন রেঞ্জে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
কীভাবে কাজ করে : ট্রান্সমিটার সাধারণত বিদু্যৎ সাপস্নাই থেকে বা ব্যাটারি থেকে এসি কারেন্ট টেনে নিয়ে বিদু্যৎ শক্তিকে বেতার তরঙ্গে রূপান্তর করে, যা প্রতি সেকেন্ডে লক্ষ-কোটিবার দিক পরিবর্তন করে। এই চলবিদু্যৎ শক্তিই একটি কন্ডাক্টর বা অ্যান্টেনার সাহায্যে তড়িৎ-চৌম্বকীয় ঢেউ বা রেডিও ওয়েভ বিকিরণ করে। ট্রান্সমিটার তথ্য বা ডাটা রেডিও তরঙ্গে রূপান্তর করে। ট্রান্সমিটার যখন অ্যান্টেনায় বার্তা পাঠায় তখন সেই বার্তা বিদু্যৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে রিসিভারের অ্যান্টেনায় পৌঁছায়। তখন রিসিভার অ্যান্টেনায় একই রকম বিদু্যৎ প্রবাহিত হয়ে শব্দ বা ডাটা উৎপন্ন করে।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ট্রান্সমিটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ট্রান্সমিটার অবশ্যই উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধিত হওয়া উচিত। যেমন- ব্রডকাস্ট, মেরিন যোগাযোগ, এয়ারব্যান্ড বা বিমান যোগাযোগ, অ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও ইত্যাদি।
আইটিইউ নামের সংস্থাটি বেতার বর্ণালি থেকে বিভিন্ন কাজের উপযুক্ত ব্যান্ড নির্ধারিত করে দেয়। বার্তা প্রেরণকারী ট্রান্সমিটারকে শনাক্ত করতে কোনো কোনো ক্লাসের রেডিও ট্রান্সমিটারকে একটি ইউনিক কল সাইন দেওয়া হয়। এ জন্য ট্রান্সমিটার পরিচালনাকারীকে অবশ্যই সরকার থেকে লাইসেন্স নিতে হয়।
কিছু কিছু ট্রান্সমিটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের বিষয়টি শিথিল করা হয়েছে যেমন- মোবাইল ফোন, কর্ডলেস টেলিফোন সেট, ওয়াকি-টকি, ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন, ওয়াইফাই এবং বস্নটুথ প্রযুক্তি, গ্যারেজ ডোর ওপেনার এবং বেবি মনিটর ইত্যাদি।