পস্নাস্টিক :ভুল থেকে মহা আবিষ্কার

পস্নাস্টিক মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয়। এটি পানিতেও মিশে যায় না। ফলে প্রাণীদের উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে আনা থেকে শুরু করে তাদের মৃতু্য পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসে পস্নাস্টিক। পস্নাস্টিকের ক্ষতিকারক দিকের কারণে একজন মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাও তৈরি হয়। আবার, পস্নাস্টিকের আছে ভালো দিকও। এই যে বড় বড় গাড়ি চলছে পথে, পস্নাস্টিকের ব্যবহার হয় বলেই এরা এত হালকা হতে পারে এবং জ্বালানি খরচ কমে আসে।

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

সাগর আহমেদ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পস্নাস্টিক এক অপরিহার্য পদার্থ। এটি জগ তৈরি থেকে শুরু করে কত না নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরিতে কাজে লাগে তা বলে শেষ করা যাবে না। থালা, বাটি, বালতি, বদনা, গস্নাস, মোবাইল, পস্নাস্টিক ডোর, খেলনা, টেবিল ক্লথ, বিমানের যন্ত্রাংশ, কৃত্রিম ফুলসহ বহুকিছু তৈরিতে পস্নাস্টিকের বহুল ব্যবহার রয়েছে। এমনকি যে পলিথিন ব্যাগ আমরা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জেনেও ব্যবহার করি, তাও এক ধরনের পস্নাস্টিক। পস্নাস্টিক হলো এক ধরনের জৈব পলিমার। এটা নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও সালফারের পুনঃপুনঃ চেইনযুক্ত রাসায়নিক সংযুক্তি। সোজা কথা এটা এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পলিমারাইজেশন। প্রশ্ন হলো আমাদের নিত্য ব্যবহার্য পস্নাস্টিক কবে আবিষ্কার করা হয়েছিল? পস্নাস্টিকের গল্পটা এত নতুন নয়। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দেড় শতক আগে মেক্সিকোতে ব্যবহার করা হয় পলিমারের বল। এরপর আরও কত শত বছর পর আসে পস্নাস্টিকের মতোই আরেকটি উপাদান 'পারকেসিন'। মজবুত রাবার আর নানারকম উপাদান তখন ডুবোজাহাজেও ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে এতকিছুতেও কিছু একটা কমতি যেন ছিল সবসময়। যেজন্য নিয়মিত নতুন কিছু আনার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। তবে সেসব আবিষ্কার নিয়ে নয়, আজ আমরা কথা বলব, আজ যে পস্নাস্টিককে চিনি, তার শুরুটা নিয়ে। অনেকটা না চাইতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এই পস্নাস্টিক। বিজ্ঞানী লিউ হেনরিক বায়েকল্যান্ড ফরমালডিহাইড ও ফেনল নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে ভুলবশত এই পস্নাস্টিক আবিষ্কার করেন ১৯০৭ সালের ১১ জুলাই। ৪৩ বছর বয়সি বিজ্ঞানী লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড তখন সবে নতুন এই পদার্থ আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানী দারুণ খুশি হয়ে একটি জার্নালে নিজের সদ্য উদ্ভাবিত এই পদার্থ নিয়ে গর্ব করে লিখলেন : 'যদি আমি ভুল না করে থাকি, আমার এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে।' তবে এই পস্নাস্টিক ব্যবহার উপযোগী হয়েছিল সত্য, তা পরিবেশ ও জলবায়ু এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর এর সীমাহীন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছিল, যা আজকের আধুনিক বিশ্বের মানুষ ও বিজ্ঞানীদের ক্রমেই শংকিত করে তুলছে। পস্নাস্টিকের উপজাত কার্বন-ডাই অক্সাইড ও কার্বন-মনোঅক্সাইড ওজন স্তর ধ্বংস করে, বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বাড়ায়, পলিথিন নামক পস্নাস্টিক নালা নর্দমায় আটকে শহরে, নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, পস্নাস্টিকের জগে বা বোতলে দীর্ঘদিন পানি পান করলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। পস্নাস্টিক সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যায় না বলে এটা জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে, পরিবেশকে করে বিষাক্ত ও ব্যাহত। লিউ হেনরিক বায়েকল্যান্ড কিন্তু কোনো অভিজাত ঘরে জন্মগ্রহণ করেননি। বেলজিয়ামের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া লিও'র বাবা পেশায় ছিলেন একজন মুচি। বাবা নিজে পড়াশোনা করেননি। লিও কেন যে এত পড়াশোনা করতে চান, সেটাও বুঝে উঠতে পারেননি। তবে লিওর মায়ের লিউকে নিয়ে অন্যরকম এক উচ্চাশা ছিল। তার ছেলে মেধার জোরে বিজ্ঞানের মহা মহা আবিষ্কার করবে- এই ছিল তার দৃঢ়বিশ্বাস। মিস্টার পস্নাস্টিকখ্যাত লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড তার মায়ের উৎসাহেই কাজের পাশাপাশি নৈশবিদ্যালয়ে পড়েন ও উচ্চ শিক্ষায় স্কলারশিপ পান। মাত্র ২০ বছর বয়সে রসায়নে ডক্টরেটও করেন। জীবন বেশ ভালোই চলছিল তার। বিয়ে করে নিউইয়র্কে এসে নিজের আবিষ্কৃত ফটোগ্রাফিক প্রিন্টিং পেপার বিক্রি করে বেশ ভালো আয় করেন লিও। কাজ করার আর প্রয়োজন ছিল না এই বিজ্ঞানীর। তবে রসায়নের প্রতি ভালোবাসা থেকেই হাডসন নদীর পাশে নিজের ঘর, আর সঙ্গে একটা গবেষণাগার নির্মাণ করেন তিনি। সেবার সেখানেই ফরমালডিহাইড এবং ফেনল নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। এই জৈব যৌগগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এই গবেষণা চালাতে গিয়ে তার কিছু ভুল হয়, আর এই ভুলের ফলেই পস্নাস্টিক আবিষ্কৃৃত হয়ে যায়। তিনি দেখেন পস্নাস্টিক নামক এই পদার্থটি সহজেই নানান আকৃতি ধারণ করে। তিনি ভাবলেন একে তো নানান কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। না চাইতেই তার এই পরীক্ষা নতুন এক আবিষ্কারের সূচনা করে দেয়। টাইম ম্যাগাজিনে পরবর্তী সময়ে বড় বড় করে ছাপা হয় তার এ আবিষ্কারের কথা। যেদিন পস্নাস্টিকের আবিষ্কার করেছিলেন লিও, তিনি নিজের নতুন এই আবিষ্কারের নাম দিয়েছিলেন 'বেকলাইট'। পস্নাস্টিকের গুরুত্ব নিয়ে খুব একটা ভুল বলেননি লিও। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তার এই আবিষ্কার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পস্নাস্টিকের দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি যে, সুজান ফ্রেইনকেল যখন এ নিয়ে নিজের বই 'পস্নাস্টিক : আ টক্সিক লাভ স্টোরি' লেখেন, তাতে তিনি একটি গোটা দিনে তার ব্যবহৃত সব পস্নাস্টিকের উপাদানের নাম লেখেন। আর তাতে দেখা যায় যে, একটি দিনে তার ব্যবহার করা ১৯৬টি জিনিসই পস্নাস্টিকের তৈরি। অন্যদিকে পস্নাস্টিক নয়, এমন জিনিসের সংখ্যা মাত্র ১০২! পস্নাস্টিকের পূর্ববর্তী বিভিন্ন রকম সেলুলয়েড তখনো রাজত্ব করছিল। সেটি সরিয়ে দিয়ে সে জায়গা দখল করে পস্নাস্টিক। তবে বায়েকল্যান্ডের বুঝতে বেশি দেরি হয়নি যে, পস্নাস্টিক সেলুলয়েডের চাইতেও অনেক বেশি ভিন্নতা ধারণ করতে সক্ষম। তিনি প্রচারণা শুরু করেন ভিন্ন ধারায়। এই একই উপাদানের হাজারটা ব্যবহার আছে, এমনটা বলে খুব একটা ভুল বলেননি লিও। টেলিফোন, বন্দুক, কফি মেকার- সবকিছুতেই একটু একটু করে প্রবেশ করে পস্নাস্টিক। আর বেকলাইটের এ সাফল্যের পরই মানুষের মধ্যে চিন্তা কাজ করে, প্রকৃতিতে নেই এমন উপাদান তৈরি করার। ইতোমধ্যে, ১৯২০-১৯৩০ এর মধ্যে পস্নাস্টিক গবেষণাগার থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় পস্নাস্টিক ছিল পলিস্টিরিন, পলিথিলিন ও নাইলন আকারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষ পস্নাস্টিকের ওপর অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের পরে জন্ম নেয় টাপারওয়্যারের মতো নিত্যনতুন সব পণ্য। ১৯৬৭ সালে 'দ্য গ্রাজুয়েট' নামক একটি চলচ্চিত্র বেশ পরিচিতি লাভ করে। সেখানে এক বয়স্ক নাগরিক একজন তরুণকে উপদেশ দিতে গিয়ে পস্নাস্টিকের কথা বলেন। সেখানে পস্নাস্টিক তখনো আগের প্রজন্মের কাছে নতুনত্ব আর নতুন সম্ভাবনার প্রতীক ছিল। আর এখন, এখনো সেটা ঠিক আগের মতোই আছে। আমাদের মানসিক দিক দিয়ে না হলেও, পরিমাণগত দিক দিয়ে প্রতি বছর পস্নাস্টিকের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যা বিশ বছর পর গিয়ে পরিমাণে দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। পস্নাস্টিক- ভালো, না খারাপ? আপনার মনে হতেই পারে যে, পস্নাস্টিক পরিমাণে অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে এবং এর হাত থেকে এখনই মুক্তি না পেলে সেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর ফলাফল বয়ে আনবে। হ্যাঁ, কথাগুলো একেবারে মিথ্যে নয়। পস্নাস্টিক মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয়। এটি পানিতেও মিশে যায় না। ফলে প্রাণীদের উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে আনা থেকে শুরু করে তাদের মৃতু্য পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসে পস্নাস্টিক। পস্নাস্টিকের ক্ষতিকারক দিকের কারণে একজন মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাও তৈরি হয়। আবার, পস্নাস্টিকের আছে ভালো দিকও। এই যে বড় বড় গাড়ি চলছে পথে, পস্নাস্টিকের ব্যবহার হয় বলেই এরা এত হালকা হতে পারে এবং জ্বালানি খরচ কমে আসে। এই পস্নাস্টিকের বোতল পানিসহ কোনো জৈব তরলে মিশে যায় না। ভঙ্গুর গস্নাসের বদলে পস্নাস্টিকের বোতল ব্যবহার করাটা নিরাপদ। এছাড়া, খাবার অনেকটা সুরক্ষিত থাকে। আমরা যে গাড়িতে চড়ে নিত্যদিন ঘুরে বেড়াই, তার অনেককিছুই এই পস্নাস্টিক দিয়ে তৈরি। কাজেই পস্নাস্টিকের ভালো, মন্দ বিশ্লেষণ করে, একে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। পস্নাস্টিকের সতর্ক ও সাবধান ব্যবহারই এর একমাত্র সমাধান। সব কাজের কাজি পস্নাস্টিককে তো আমরা একেবারে ফেলে দিতে পারি না।