রোববার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

আমলকীর মাধ্যমে কমানো সম্ভব ব্রয়লারের হিট স্ট্রেস

মো. আশিকুজ্জামান, বাকৃবি
  ২২ জুন ২০২৪, ০০:০০
আমলকীর মাধ্যমে কমানো সম্ভব ব্রয়লারের হিট স্ট্রেস

সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে ও কোনো ধরনের কৃত্রিমতা ব্যবহার না করে ব্রয়লার মুরগিতে তাপপ্রবাহের ফলে সৃষ্টি হওয়া হিট স্ট্রেসের প্রভাব কমানোর পাশাপাশি আমলকীর নির্যাস বা পাউডার খাদ্য এবং পানির সঙ্গে ব্যবহার করলে উচ্চ তাপমাত্রাতেও ব্রয়লার মুরগির খাবার গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।

বাকৃবির প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান (বিএমবি) বিভাগের অধ্যাপক ড. চয়ন গোস্বামী ও পোলট্র্রি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাপন দে'র তত্ত্বাবধানে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ফেলোশিপের অর্থায়নে বিএমবির প্রভাষক মো. কামরুল হাসান কাজল ওই গবেষণা সম্পন্ন করেন।

আমাদের দেশে ব্রয়লার হিট স্ট্রেস কমানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন, সম্পূর্ণ খামারে এয়ার কন্ডিশন বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা অথবা কিছু সিনথেটিক ড্রাগস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব পদ্ধতি আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের জন্য মোটেও লাভজনক নয়। তাই ওই খামারিদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই সমাধান হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে হিট স্ট্রেসের প্রভাব কমানোর উপায় বের করা। এক্ষেত্রে আমলকী অত্যন্ত কার্যকরী বলে জানিয়েছেন বিএমবির প্রভাষক মো. কামরুল হাসান কাজল।

ব্রয়লারে আমলকীর বিভিন্ন উপকারী দিক সম্পর্কে সহযোগী অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, ব্রয়লারের খাদ্যের সঙ্গে আমলকীর নির্যাস বা পাউডার মিশিয়ে দিলে খাবার গ্রহণে কোনো সমস্যা দেখা যায় না। কেননা আমলকীর পাউডার খাবারের স্বাদে কোন পরিবর্তন করে না। তাছাড়া আমলকীর এই পাউডার ব্রয়লারের ক্ষুধাবর্ধক হিসেবেও কাজ করে। তাই মুরগি খাবার গ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

আমলকীকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প দাবি করেছেন অধ্যাপক বাপন দে। তিনি বলেন, আমলকী উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। অ্যান্টিবায়োটিকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকলেও আমলকীর পাউডার প্রাকৃতিক হওয়ায় কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এতে ফাইটোকেমিক্যাল থাকায় তীব্র গরমেও ব্রয়লারের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে।

ওই অধ্যাপক আরও বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে আমলকী ব্যবহারে মুরগির পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমে যায় এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।

উচ্চ তাপমাত্রায় আমলকীর মাধ্যমে বিরূপ প্রভাব কমানোর পদ্ধতি সম্পর্কে বিএমবি বিভাগের অধ্যাপক ড. চয়ন গোস্বামী বলেন, দ্রম্নত বিপাকীয় হার, বৃদ্ধি ও ঘর্মগ্রন্থি না থাকায় ব্রয়লার হিট স্ট্রেসের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল। উচ্চ তাপমাত্রায় মুরগির দেহে প্রচুর পরিমাণ ফ্রি রেডিক্যাল ও রিয়েক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস (আরওএস) উৎপন্ন হয় যা শরীলে আমিষ, লিপিড, ডিএনএ ও শক্তি উৎপাদন হ্রাস করে। কিন্তু আমলকী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় ফ্রি রেডিক্যাল ও আরওএসের ক্ষতিকর প্রভাবকে কমিয়ে দেয় যা ওজন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।

খামারিদের ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে সহজ উপায়ে আমলকীর ওই পাউডার তৈরি করা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক চয়ন। তিনি বলেন, প্রথমে সংগৃহীত আমলকী পরিষ্কার করে হালকা ছায়াযুক্ত রোদে শুকানো হয়েছে। এরপর বীজগুলো ফেলে দিয়ে বাকি অংশ পুনরায় হালকা ছায়াযুক্ত রোদে শুকিয়ে পাউডার তৈরি করা হয়েছে।

ব্রয়লারে আমলকী পাউডার ব্যবহার বিধি সম্পর্কে অধ্যাপক চয়ন বলেন, এক কেজি আমলকী থেকে ১৫০-১৯০ গ্রাম পর্যন্ত পাউডার পাওয়া যায়। গবেষণায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও এক শতাংশ ডোজ দু'টি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এক কেজি খাবারের সঙ্গে ৫ অথবা ১০ গ্রাম পাউডার মিশিয়ে খাওয়ানো যাবে।

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ অসংখ্য উদ্ভিদ থাকলেও ব্রয়লারের ওপর কেনো আমলকী ব্যবহার করা হলো এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক চয়ন বলেন, অন্যান্য উৎসের তুলনায় আমলকীতে ভিটামিন সি'র পরিমাণ বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম আমলকীতে ৫০০ থেকে ৭০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ভিটামিন সি পাওয়া যায়। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আমলকির উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড ও দেশীয় প্রজাতির আমলকী পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমলকীর মতো বিভিন্ন ঔষধি গাছ লাগানোর প্রকল্পও হাতে নিয়েছে।

উচ্চ তাপমাত্রায় আমলকীর পাউডার ব্যবহারের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে ব্রয়লারের ওজন বৃদ্ধি ও তাপমাত্রাজনিত মৃতু্য হ্রাস পেয়েছে। তবে ভবিষ্যতে ব্রয়লার মুরগিতে আমলকীর ব্যবহার নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক চয়ন।

তিনি বলেন, ব্রয়লারের কোন অঙ্গে আমলকী কেমন প্রভাব ফেলছে তা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে আমলকীর তুলনামূলক গবেষণা করে দেখতে হবে। ব্রয়লারে হিট স্ট্রেসের প্রভাব কমাতে আমলকীর ফাইটোকেমিক্যালগুলোর মধ্যে কোনটি সক্রিয় উপাদান হিসেবে কাজ করে তা বের করতে হবে। এই তিনটি বিষয়ে ভালোভাবে গবেষণা করলে পোলট্র্রি খাতে আমলকী অভূতপূর্ব অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে