যে যন্ত্রের মাধ্যমে সময় পরিমাপ হয় তার নাম ঘড়ি। ঘড়ি আসলে এমন একটি যন্ত্র যার সাহায্যে ২৪ ঘণ্টার সময় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি পাওয়া যায়। যেমন হাত ঘড়ি, দেয়াল ঘড়ি ইত্যাদি। ঘড়ি একটি অদ্ভুত যন্ত্র। পৃথিবীর সব থেমে গেলেও ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকে না। একটানা চলতেই থাকে। অনেকের মধ্যেই ঘড়ি সম্পর্কে একটি কৌতূহল আছে, ঘড়ির কাঁটা কেন ডান দিকে ঘোরে? আমরা এখন যে কাঁটাওয়ালা ঘড়ি ব্যবহার করি, তা প্রথম উদ্ভাবন হয়েছিল ইংল্যান্ড অথবা ইউরোপেরই অন্য কোনো একটা দেশে। সময়টা ছিল সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীর দিকে।
তবে এ জাতীয় ঘড়ি আবিষ্কারের বহু বছর আগে আমাদের এই পৃথিবীতে ছিল সূর্যঘড়ি যা প্রাচীন মিশরীয়দের তৈরি। আর এরাই পৃথিবীর বুকে প্রথম সূর্যঘড়ির ব্যবহার করা শুরু করে। এ ঘড়ি আবিষ্কারের কারণেই মিশরীয়দের নাম ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা আছে। ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ে পড়ে এসেছি ঘড়ির ইংরেজি হলো ক্লক? কিন্তু আদতে ক্লক শব্দটি ইংরেজি কোনো শব্দ নয়? এটি ল্যাটিন শব্দ ক্লক্কা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। পরে ইউরোপীয়ানরা এই ক্লক্কাকে পরিণত করেছে ক্লকে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে পুরনো যে ঘড়িগুলো ছিল, সেগুলোতে কিন্তু এখনকার ঘড়ির মতো কাঁটা ঘোরাঘুরির কোনো ব্যাপার ছিল না। সূর্যঘড়ি ছিল এরকমই একটি কাঁটাহীন ও সেকেলে ঘড়ি। সেই সময়ে সূর্যঘড়ি অনেক রকমের ছিল। মিশরীয়দের 'ওবেলিস্ক' ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন সূর্যঘড়ি। আন্দাজ করা হয়, মিসরীয়রা এই ঘড়ি তৈরি করেছিল যিশু খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে তিন হাজার বছর আগে।
এ ছাড়া সূর্যঘড়ির মতো আরেকটি ঘড়ি ছিল যার নাম 'শ্যাডো ক্লক'। সেটা যিশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ব্যাবিলনীয়রা তৈরি করেছিল।
সূর্যঘড়ি বানাতে প্রাচীনকালের মিশরীয়রা খোলা জায়গায় মাটির উপরে একটা দন্ড পুঁতে রাখত। তারপর সেই দন্ডকে ঘিরে মাটির মধ্যে ছোট-বড় নানা রকমের চক্র আঁকা হতো সময় মাপার জন্য। ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘোরার আসল কারণই হচ্ছে সূর্যঘড়ি। সূর্যঘড়ির প্রধান অংশ হলো এই দন্ড, যাকে এহড়সড়হ বলা হয়। সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দন্ডের ছায়ার অবস্থানও পরিবর্তন হয়। এই ছায়া থেকেই সুদূর অতীতে সময় নির্ণয় করা হতো। আর সূর্যঘড়িতে সময়-নির্দেশক কাঁটা বা দন্ডটি না ঘোরে স্থির থাকত। কিন্তু এখনকার ঘড়িতে পুরোটাই উল্টো। কাঁটা রয়েছে তিনটি। ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড। এই কাঁটাগুলোই ঘুরে ঘুরে সময় জানান দেয়। ছায়া দেখে সময় নির্ণয় করার এখন আর প্রশ্নই আসে না। এই জাতীয় ঘড়ি কারও কারও মতে ১৩ শতকে প্রথমে বানানো হলেও ১৬ শতকে এসে পূর্ণতা পায়। তবে সে সময়েও এই কাঁটাওয়ালা ঘড়িগুলো তেমন একটা লোকপ্রিয়তা পায়নি। এর কারণ একটাই, সেটা হলো মানুষের তখনো সময় দেখার প্রয়োজন পড়েনি। সূর্য দেখেই মানুষ বুঝে নিত এই মুহূর্তে সকাল না দুপুর, বিকাল না সন্ধ্যা। আদতে সময় নিয়ে মানুষের মাথা ঘামানোর তেমন একটা প্রয়োজন পড়েনি। ইউরোপে ঘড়ি আবিষ্কারের প্রায় ৪০০ বছর পরে অর্থাৎ ১৮ শতকে মানুষ যখন কলকারখানা বানিয়ে কাজ শুরু করে, তখনই মানুষের নির্ধারিতভাবে সময় দেখার প্রয়োজন পড়ে। নির্ধারিত সময়ে কলকারখানায় যাওয়া, নির্ধারিত সময়ে দুপুরের খাবার খেয়ে পুনরায় কাজে লাগা, সময়মতো সব কাজ সম্পন্ন করা, নির্ধারিত সময়ে কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে ফেরা- এরকম কঠিন নিয়ম মানতে গিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আধুনিক কাঁটাওয়ালা ঘড়ির প্রয়োজন পড়ে। আর এ সময়টাতেই ঘড়ি মানবজাতির কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনাধুনিক যুগে সূর্যঘড়ি ছাড়াও আরও কিছু ঘড়ির নাম জানা যায়। তারমধ্যে চীনে আবিষ্কৃত জলঘড়ি অন্যতম। তা ছাড়া বালুঘড়ি, বিদু্যৎ ঘড়ি উলেস্নখ করার মতো।
ঘড়ির কাঁটা কেন ডান দিকে ঘোরে সে সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে হলে পৃথিবীর প্রাচীন সূর্যঘড়ি কীভাবে কাজ করত সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হবে। পাঠকরা কমবেশি সবাই বিদিত যে, ইউরোপ মহাদেশ পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে স্থিত হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই সূর্য সেখানে দক্ষিণদিকে হেলে থাকে। যে কারণে দিনের বেলা সময় যতই অতিবাহিত হয়, সূর্য যতই উপরে ওঠে, ততই সূর্যঘড়িতে থাকা দন্ডটির ছায়া বাম থেকে ডানদিকে সরতে থাকে। সেখানে সূর্য যখন পুব থেকে পশ্চিমে যায়, তখন সূর্যঘড়িতে থাকা দন্ডটির ছায়াও বাম থেকে ডান দিকে যায় অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পুবে সরে আসে। এর ওপর ভিত্তি করেই ঘড়ির কাঁটা বাম থেকে ডানদিকে ঘোরানোর চিন্তা, মানুষের মাথায় আসে।