মেঘের বিচিত্র রহস্য
লেসার রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে লিডার (লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং)-এর সাহায্যে উচ্চতা, দূরত্ব, ঘনত্ব, তাপমাত্রা প্রভৃতি তথ্য সহজেই পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও (যা খালি চোখে বুঝা সম্ভব নয়) লিডারের মাধ্যমে জানা সম্ভব। বিজ্ঞানের বৈপস্নবিক পরিবর্তনের ফলে এখন কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মেঘের অবস্থান এবং মেঘের ছবি তুলে পৃথিবীর বিভিন্ন আবহাওয়া কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। আর আমরাও সহজেই ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন রকম মেঘের আকৃতি ও অবস্থান।
প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
প্রদীপ সাহা
আকাশে সাদা সাদা তুলার মতো যে বস্তু ভাসতে দেখা যায়, সাধারণভাবে তাকেই বলা হয় মেঘ। কিন্তু মেঘ হলো বাতাসে ভাসমান ধুলিকণাকে আশ্রয় করে অসংখ্য হালকা জলকণার সমষ্টি। ভূপৃষ্ঠ থেকে সূর্যের তাপে পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে ওপরে ওঠে। বাতাসের চেয়ে হালকা এই জলীয় বাষ্প এভাবে ওপরে উঠতে উঠতে ক্রমে ঠান্ডা হতে থাকে এবং এরপর একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছে গেলেই তা আরও ঠান্ডা হয়ে জলকণায় পরিণত হয়।
সাধারণভাবে দেখা যায়, বায়ুতে ভেসে থাকা অসংখ্য ধুলিকণাকে আশ্রয় করে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয় এবং জলকণায় পরিণত হয়। বহুকাল থেকে মানুষ মেঘের বিভিন্নতা লক্ষ্য করলেও ১৮০৩ সালে ইংরেজ রসায়নবিদ লিউক হাওয়ার্ড মেঘের শ্রেণিবিন্যাসে বিশেষ তৎপর হন। তিনি আকৃতি ও চেহারা অনুসারে মেঘকে চার ভাগে ভাগ করেন। এগুলো হলো- সিরাস বা অলক মেঘ, স্ট্র্যাটাস বা স্তর মেঘ, কিউমুলাস বা স্তূপ মেঘ এবং নিম্বাস বা ঝঞ্ঝা মেঘ। এ ছাড়া মেঘের উচ্চতার অবস্থান অনুসারে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে মেঘের উচ্চতা অনুযায়ী মেঘকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে- উঁচু আকাশের মেঘ, মাঝারি আকাশের মেঘ এবং নিচু আকাশের মেঘ। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সমিতি ১৮৯৪ সালে আকার ও উচ্চতা অনুসারে মেঘকে ১০ ভাগে ভাগ করে। পরে আকাশের বুকে ২৮ ধরনের মেঘের কথা বলা হয়। উঁচু আকাশের মেঘ সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার মিটার থেকে ছয় হাজার মিটারের মধ্যে থাকে। এই স্তরের মেঘগুলো হচ্ছে সিরাস বা অলক মেঘ, সিরোকিউমুলাস বা অলক স্তূপ মেঘ এবং সিরো স্ট্র্যাটাস বা অলক স্তর মেঘ। সিরাস বা অলক মেঘ দেখতে হালকা পেঁজা তুলা বা সাদা পালকের মতো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ বা তুষার কণার সমন্বয়ে এই মেঘ গঠিত।
আবহাওয়া যখন ভালো থাকে অর্থাৎ যখন সূর্যের আলো ঝলমল করে, তখন এ ধরনের মেঘ দেখা যায়। এই মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সিরোকিউমুলাস বা অলক স্তূপ মেঘ দেখতে হালকা সাদা ঢেউয়ের মতো এবং কিছুটা গোলাকার। শরতের আকাশে এই মেঘ খুবই সুন্দর দেখায়। খুবই সুক্ষ্ণ তুষার কণা দিয়ে এই মেঘ গঠিত। এই মেঘ থেকেও বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সিরো স্ট্র্যাটাস বা অলক স্তর মেঘ ধব ধবে সাদা। আকাশের অনেক উঁচুতে এই মেঘ ভেসে বেড়ায়। বৃষ্টি হওয়ার পর আকাশে যে রংধনু দেখা যায়, তা আর কিছুই নয়- মেঘের ওপরই সূর্যের আলোর প্রতিসরণ।
মাঝারি আকাশের মেঘ সাধারণত দুই হাজার ১০০ মিটার থেকে ছয় হাজার মিটারের মধ্যে থাকে। এই স্তরের মেঘগুলো হচ্ছে অল্টো স্ট্র্যাটাস বা স্তর মেঘ, অল্টো কিউমুলাস বা স্তূপ মেঘ। অল্টো স্ট্র্যাটাস বা স্তর মেঘ ধূসর চাদরের মতো আকাশজুড়ে ভেসে থাকে। এর মধ্য দিয়ে সূর্যকে দেখলে একটি স্বল্প আলোর বাতি বলে মনে হয়। ধূসর ছাড়াও মেঘের রঙ কখনো কখনো নীলাভ হয়ে থাকে। এ জাতীয় মেঘ থেকে বিরাট অঞ্চলজুড়ে অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিপাত হয়। অল্টো কিউমুলাস বা স্তূপ মেঘ দেখতে গোল- পাকানো পশমের মতো। এই মেঘে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। তবে বেশিমাত্রায় জমলে হালকা ধরনের বৃষ্টি হতে পারে।
নিচু আকাশের মেঘ সাধারণত দুই হাজার ১০০ মিটারের নিচে অবস্থান করে। এই স্তরের মেঘগুলো হচ্ছে স্ট্র্যাটাস, নিম্বো স্ট্র্যাটাস, নিম্বাস ও স্ট্র্যাটো কিউমুলাস। স্ট্র্যাটাস মেঘের রং ধূসর। ঘন কুয়াশার মতো স্তরে স্তরে সাজানো থাকে এই মেঘ। এ জাতীয় মেঘের উচ্চতা খুব বেশি নয়। ভারতের দার্জিলিং, মুসৌরি প্রভৃতি শহরের উঁচু বাড়ির জানালা দিয়ে মেঘ ঘরে ঢুকে যায়। এই মেঘে সবচেয়ে বিপদে পড়ে বিমানচালক ও পর্বতারোহী। এ জাতীয় মেঘ থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। নিম্বো স্ট্র্যাটাস মেঘ দেখতে গাঢ় ধূসর কালো রঙের এবং এটি আকাশজুড়ে স্তরে স্তরে সাজানো থাকে। আকাশে এ জাতীয় মেঘ থাকলে ভয়ের ব্যাপার। বিশেষ করে সাইক্লোনের সময় এ ধরনের মেঘ দেখা যায়। এই মেঘ থেকে বৃষ্টি হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কালো ও ধূসর রঙের নিম্বাস মেঘ বর্ষায় সারা আকাশ ঢেকে ফেলে। এই মেঘের কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। স্ট্র্যাটো কিউমুলাস গাঢ় ধূসর থেকে কালো পর্যন্ত হতে পারে। নদীর ধারে সমভূমি অঞ্চলে শীতকালে কোনো কোনো সময় আকাশে এ জাতীয় মেঘ দেখা যায় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
এসব হরেক রকমের মেঘ আকাশজুড়ে থাকলেও কোনো একটি মেঘকে কিন্তু আলাদাভাবে দেখা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটির সঙ্গে আরেকটি বা অনেক মেঘ একত্রে মিশে আকাশে ভেসে বেড়ায়। মজার ব্যাপার হলো, উঁচু আকাশের (৬ হাজার মিটারের ওপর) মেঘগুলো নিজেদের আকৃতি, রঙ, চেহারা সবসময় পাল্টাতে থাকে। এ রকম মেঘ যেকোনো সময় অন্যরকম মেঘে পরিবর্তিত হয়। এ কারণে আবহাওয়াবিদরা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে মাঝে মাঝে ভীষণ জটিলতার সম্মুখীন হন। মেঘের ধরন, গঠন ও অবস্থান জানার জন্য তাই তারা মেঘের ওপর উজ্জ্বল আলোকরশ্মি ফেলেন এবং মেঘের ওপর সেই প্রতিফলিত আলোক বিশ্লেষণ করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে চেষ্টা করেন।
মেঘের ধরন ও অবস্থান জানার কাজে 'সিলোমিটার' যন্ত্রটি বহু প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু সিলোমিটারের আলোকরশ্মি মেঘের স্তরকে ভেদ করতে পারে না বলে বেশি উঁচুতে থাকা মেঘগুলো সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য বা পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হয় না।
কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। এ অবস্থার পরিবর্তন বা উন্নতির জন্য আবিষ্কার হয় 'লেসার' নামে একটি যন্ত্র। লেসারের রশ্মি বিশেষভাবে সুসংবদ্ধ এবং এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। এ ছাড়া লেসার রশ্মির ভেদক্ষমতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি। আর এ কারণে পরবর্তীতে সিলোমিটারের ব্যবহার কমে আসে। এরপর বিজ্ঞান ক্রমান্বয়ে আরও এগিয়ে গেছে। রাডার (রেডিও ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং)-এর সাহায্যে যেভাবে দূর আকাশে থাকা শত্রম্নপক্ষের বিমানের অস্তিত্ব ভূমি নিরীক্ষণ কেন্দ্রে ধরা পড়ে, ঠিক সেভাবে লেসার রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে লিডার (লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং)-এর সাহায্যে উচ্চতা, দূরত্ব, ঘনত্ব, তাপমাত্রা প্রভৃতি তথ্য সহজেই পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও (যা খালি চোখে বুঝা সম্ভব নয়) লিডারের মাধ্যমে জানা সম্ভব। বিজ্ঞানের বৈপস্নবিক পরিবর্তনের ফলে এখন কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মেঘের অবস্থান এবং মেঘের ছবি তুলে পৃথিবীর বিভিন্ন আবহাওয়া কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। আর আমরাও সহজেই ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন রকম মেঘের আকৃতি ও অবস্থান।