মহাবিশ্বের চমকপ্রদ বিরল ছবি

পৃথিবীর মতো যেসব গ্রহের বাতাসে গ্যাস রয়েছে, একদিন হয়তো ওয়েব টেলিস্কোপ সেসব গ্রহের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে সক্ষম হবে। সেটা হলে ওইসব গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সত্যি সত্যিই একদিন মহাকাশের সব রহস্য ভেদ করে বিভিন্ন রঙিন ও চমকপ্রদ ছবি আমাদের আরও উপহার দেবে, এই বিশ্বাস এই বিজ্ঞানের যুগে আমরা করতেই পারি

প্রকাশ | ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০

প্রদীপ সাহা
মার্কিন গবেষণা সংস্থা 'ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন' (নাসা) ২০২২ সালে 'জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ' দিয়ে তোলা মহাবিশ্বের কয়েকশ' কোটি বছর আগের প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন ও চমকপ্রদ ছবি প্রকাশ করে ১২ জুলাই। এ যাবশ এটাই হচ্ছে মহাজগতের প্রাচীনতম অবস্থার সবচেয়ে বিস্তারিতভাবে তোলা চিত্র। ছবিতে তারামন্ডলি ও ছায়াপথের যে আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ দেখা যায়, তা শত শত কোটি বছর পাড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। এক হাজার কোটি ডলার মূল্যের 'জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ' উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর। মহাকাশে সুপরিচিত 'হাবল টেলিস্কোপ'-এর জায়গা নিতে তৈরি করা হয় 'জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ'। এই টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র আকাশে অনেক কিছুই পর্যবেক্ষণ করবে। এর প্রধান দুটি লক্ষ্য রয়েছে। একটি হলো- মহাকাশে ১৩৫০ কোটি বছর আগে একেবারে প্রথম জন্ম নেওয়া তারাগুলোর আলোর বিচ্ছুরণ কীভাবে ঘটেছিল, এর ছবি নেওয়া এবং দ্বিতীয়টি হলো দূরের গ্রহগুলো মানুষের বাসযোগ্য কিনা, তা অনুসন্ধান করা। নাসার গবেষক বিল নেলসন বলেছেন, 'আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল এবং ছবিতে ছোট ছোট যে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা গেছে, সেগুলো ভ্রমণ করেছে ১৩০০ কোটি বছর। তবে আমরা আরও পেছনে ফিরে যাচ্ছি। কারণ, এটা হলো প্রথম ছবি- ১৩৫০ কোটি বছর পেছনের ছবি। আমরা জানি, মহাজগতের বয়স ১৩৮০ কোটি বছর। তাই মহাবিশ্ব সৃষ্টির একেবারে গোড়ায় আমরা ফিরে যেতে পারছি।' 'নাসা' জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের যে ছবিটি প্রকাশ করেছে, এতে দেখানো হয়েছে, এই টেলিস্কোপ যন্ত্র প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনে সক্ষম। এটা হলো দক্ষিণ গোলার্ধের এক গুচ্ছ ছায়াপথ; যেটি ভোলান্স নক্ষত্রপুঞ্জ- যার নাম দেওয়া হয়েছে 'এসএমএসিএস ০৭২৩'। এই নক্ষত্রপুঞ্জ খুব একটা দূরে নয়। এটি প্রায় সাড়ে চারশ' কোটি আলোক বর্ষ দূরে। কিন্তু এর ভর এমনভাবে বেঁকে গেছে, যাতে এর আলোর বিচ্ছুরণ ব্যাপকভাবে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। এটা মাধ্যাকর্ষণের একটা প্রভাব। একটা টেলিস্কোপ যন্ত্রে জুম লেন্স ব্যবহার করলে যেমন দেখা যায়, এটা জ্যোতির্মন্ডলে সেই জুম লেন্সের মতো কাজ করেছে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। এতে ৬ দশমিক ৫ মিটার চওড়া সোনার প্রলেপ লাগানো প্রতিফলক আয়না আছে। আছে অতি সংবেদনশীল ইনফ্রারেড তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের যন্ত্রপাতি। ই-টেলিস্কোপ ছায়াপথের বেঁকে যাওয়া ওই আকৃতির ছবি ধরে রাখতে সক্ষম। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পর এই ছায়াপথগুলো স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৬০ কোটি বছর। মহাজগতের বয়স বলা হচ্ছে ১৩৮০ কোটি বছর। বিজ্ঞানীরা ওয়েব টেলিস্কোপের তথ্যের গুণগত মান বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারছেন, ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে, এই টেলিস্কোপ তার থেকেও অনেক গভীরে গিয়ে মহাজগতের চিত্র তুলে আনতে সক্ষম। এর ফলে অতি শক্তিশালী এই টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে এখন মহাশূন্যের অনেক ভেতর পর্যন্ত দেখা এবং তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ তার প্রতিশ্রম্নতি পূরণ করবে- এ বিষয়ে নাসার বিজ্ঞানীদের কোনো সন্দেহ নেই। প্রকল্পের একজন শীর্ষ বিজ্ঞানী ড. অ্যাম্বার স্ট্রঘন বলেন, 'আমি প্রথম ছবিটি দেখেছি এবং তা অত্যন্ত চমকপ্রদ। ছবি হিসেবে এগুলো সত্যিই অসাধারণ। কিন্তু এগুলোর বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, এতে আমি দারুণভাবে উৎসাহিত।' ওয়েব প্রকল্পের বিজ্ঞানী ড. এরিক স্মিথ বলেছেন, 'এই নতুন টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র যে বিশাল একটা সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, তা মানুষ বুঝতে পারছে বলেই তার ধারণা। ওয়েব টেলিস্কোপের নকশা যেভাবে ওয়েব কাজ করে, সেসবই মূলত সাধারণ মানুষকে এই টেলিস্কোপের মিশন সম্পর্কে উৎসাহী করে তুলেছে। এটা দেখে মনে হবে যেন ভবিষ্যতের একটা মহাকাশযান।' এর আগে 'হাবল টেলিস্কোপ'-কে এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে আকাশে পর্যবেক্ষণ করতে হতো। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মাত্র সাড়ে ১২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে মহাবিশ্বের গভীর থেকে এই ছবি তুলে এনেছে। নাসা এবং তার আন্তর্জাতিক অংশীদার সংস্থা, ইউরোপীয়ান এবং কানাডিয়ান স্পেস সংস্থা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আরও রঙিন ছবি প্রকাশ করেছে। ওয়েব টেলিস্কোপ 'ওয়াস্প-৯৬ বি' নামে একটি বিশালাকৃতির গ্রহের বায়ুমন্ডল বিশ্লেষণ করেছে। এই গ্রহ পৃথিবী থেকে এক হাজার আলোকবর্ষ দূরে। ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের ওই গ্রহের আবহাওয়া মন্ডলের রসায়ন জানাতে পারবে। তবে 'ওয়াস্প-৯৬ বি' তার উৎস নক্ষত্রটির খুব কাছ দিয়ে কক্ষপথে ঘুরছে, যার ফলে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা হয়ত অসম্ভব। তবে বিজ্ঞানীদের আশা, পৃথিবীর মতো যেসব গ্রহের বাতাসে গ্যাস রয়েছে, একদিন হয়তো ওয়েব টেলিস্কোপ সেসব গ্রহের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে সক্ষম হবে। সেটা হলে ওইসব গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সত্যি সত্যিই একদিন মহাকাশের সব রহস্য ভেদ করে বিভিন্ন রঙিন ও চমকপ্রদ ছবি আমাদের আরও উপহার দেবে, এই বিশ্বাস এই বিজ্ঞানের যুগে আমরা করতেই পারি।