বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

খাদ্য সমস্যার টেকসই সমাধানে শৈবাল

আমরা অনেকেই শৈবাল শব্দটির সঙ্গে পরিচিত কিন্তু এর পূর্ণ ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত নই। আমরা জানিও না আগামী বিশ্বের অনেক সমস্যা সমাধান করবে এই শৈবাল। আগামীর বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে মানুষের সামনে থাকবে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট। এই সমস্যার সমাধাননির্ভর করবে কিভাবে বিকল্প উৎস থেকে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারে বিজ্ঞানীরা
অলোক আচার্য
  ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০
খাদ্য সমস্যার টেকসই সমাধানে শৈবাল

শৈবাল দীঘিরে কহে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই উক্তির প্রথমেই যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি শৈবাল। আমরা অনেকেই শৈবাল শব্দটির সঙ্গে পরিচিত কিন্তু এর পূর্ণ ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত নই। আমরা জানিও না আগামী বিশ্বের অনেক সমস্যা সমাধান করবে এই শৈবাল। আগামীর বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে মানুষের সামনে থাকবে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট। এই সমস্যার সমাধাননির্ভর করবে কিভাবে বিকল্প উৎস থেকে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারে বিজ্ঞানীরা। এই বিকল্পগুলোর তালিকায় অনেক খাদ্যই রয়েছে। যেমন- কৃত্রিম মাংস। তবে আরও একটি বিকল্প রয়েছে খাদ্য তালিকায়। সেটি হলো সামুদ্রিক শৈবাল।

শৈবাল এক ধরনের সালোক-সংশ্লেষণকারী ফুলবিহীন উদ্ভিদ এবং যা কিনা সাধারণত সাগর বা নদীর তলদেশে জন্মায়। এর কোনো শেকড়, ডালপালা ও পাতা থাকে না। মূলত তিন ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল দেখতে পাওয়া যায় সারা বিশ্বব্যাপী- লাল, বাদামি এবং সবুজ। শৈবাল পৃথিবীর মোট ফটোসিনফেসিসের ৬০ ভাগ করে থাকে। সিউইড বা সামুদ্রিক শৈবালকে 'সুপারফুড' বলা হয় বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে। বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় দাবি করেছেন, সামুদ্রিক শৈবাল হতে পারে আগামী খাদ্য ও জ্বালানি জোগানের অন্যতম উৎস। ইউরোপে ইতোমধ্যে শৈবালকে রূপান্তরিত করার কাজ শুরু হয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোতেও বিস্তর গবেষণা হচ্ছে, শৈবালকে শুকিয়ে কীভাবে ব্যবহার করা যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সামুদ্রিক শৈবাল সর্বপ্রথম চাষ শুরু হয়েছিল জাপানের টোকিও উপসাগরে ১৬৪০ সালের দিকে। এ ছাড়া পরে বাণিজ্যিকভাবে সর্বপ্রথম সামুদ্রিক শৈবাল চাষের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪০ সালে। অর্থাৎ খাদ্য হিসেবে শৈবালের যাত্রা বহু বছর আগেই শুরু হয়েছিল। খাদ্য চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে বিকল্পের উৎস সন্ধানে ছুটছে বিজ্ঞানীরা।

কৃত্রিম পন্থায় উৎপাদিত শৈবাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, টুথপেস্ট, কসমেটিকস ও প্রাণী খাদ্য তৈরি করা সম্ভব। এ ছাড়া বিভিন্ন মানের কাপড় (পস্নাস্টিকের বিকল্প), ক্যাপসুলের খোলস ও পাইপও তৈরি করা সম্ভব। সমুদ্র এমনিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদের উৎস। সমুদ্র থেকে আহরিত মৎস ও বিভিন্ন সামুদ্রিক সম্পদ মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এর সঙ্গে শৈবাল যোগ হলে তা সমুদ্রের গুরুত্বকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। যদিও সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করে তৈরিকৃত খাদ্য মানুষের পাতে পৌঁছে গেছে। তবে তার পরিমাণ বেশি নয়। অথচ পৃথিবীতে খাদ্য সংকটে রয়েছে বহু সংখ্যক মানুষ। এটি বাংলাদেশে কিভাবে উপকারে আসতে পারে সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের রয়েছে বিশালাকৃতির বঙ্গোপসাগর। আর সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে বেশ জোরেশোরেই আলোচনা চলছে। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করা সম্ভব এই সমুদ্র অর্থনীতি কাজে লাগিয়ে। দেশের জনসংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ খাদ্য। আর কৃষিজমিই এখন পর্যন্ত খাদ্য চাহিদা পূরণের মূল ভরসা। কিন্তু যে হারে দেশের কৃষিজমি কমছে তাতে একদিন পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে। এই সমস্যার একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে এই সুপার ফুড যা একই সঙ্গে খাদ্য চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টির দিকটাও সমানভাবে পূরণ করতে পারে। এ ছাড়া এত বিশাল এরিয়া নিয়ে আমাদের সমুদ্রসীমা যে চাইলে এটিকে কাজে লাগাতে পারি এবং খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারি। তিন ধরনের শৈবালের মধ্যে সবুজটি সাধারণত খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর লালটি হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আর বাদামি শৈবাল খাবার এবং হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন উভয় কাজেই ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ২২০ প্রজাতির সি-উইড বা শৈবাল পাওয়া যায়।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৬ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে সিংহভাগই উৎপন্ন হয়ে থাকে এশিয়ার দেশগুলো (চীন, জাপান, ফিলিপাইন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায়) মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ উৎপাদন করে। বিশ্বব্যাপী শৈবালের বাজারের বড় অংশই চীনের দখলে রয়েছে। শুধু চীন একাই মোট চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে। বর্তমানে ২৬ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক শৈবালের মোট মূল্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে, বৈশ্বিক সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদনের ৪০% সরাসরি মানুষের খাদ্য হিসেবে, ৪০% পরোক্ষভাবে প্রক্রিয়াজাত খাবার হিসেবে এবং বাকি ২০% শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং মোহনা অঞ্চলগুলোতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭৭ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল রেকর্ড করা হয়েছে। জাপানের জিডিপির ২১ শতাংশ আসে সামুদ্রিক শৈবাল রপ্তানি এবং এই থেকে উৎপাদিত সামগ্রী থেকে। চীনের ১৪-১৫ শতাংশ ও কোরিয়ার ৮-১০ শতাংশ জিডিপি গড়ে এই খাত থেকে আসে। জাতিসংঘ কমট্রেডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৯৮টি দেশ সামুদ্রিক শৈবাল (ইউএসডি ৯০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং সামুদ্রিক শৈবালভিত্তিক হাইড্রোকোলয়েড রপ্তানির মাধ্যমে (ইউএসডি ১.৭৪ বিলিয়ন) ২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।

শৈবাল হলো সবচেয়ে দ্রম্নত বর্ধনশীল শেওলা। সূর্যরশ্মি থেকে জ্বালানি, সমুদ্রের পানি থেকে পুষ্টি ও কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে বেঁচে থাকে শৈবাল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শৈবাল জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে শৈবাল থেকে সরাসরি দ্রম্নত খাদ্য তৈরি করতে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। কারণ যারা ইতোমধ্যে শৈবাল নিয়ে কাজ করছেন তাদের মত হলো, শৈবাল দ্রম্নত প্রক্রিয়াজাত করা যায় না বিধায় খাদ্য তৈরি করতে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয় যা একটু জটিল প্রক্রিয়া। এখানে প্রযুক্তিগত জটিলতা রয়েছে। যদি এটা সহজ হয় তাহলে খাদ্য তালিকায় দ্রম্নত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে সামুদ্রিক শৈবাল। শৈবাল শুকানোর কোনো কার্যকরী পদ্ধতির আবিষ্কার হয়নি। রোদে শুকালে শৈবালের গুণগতমান অনেক কমে যায়। আবার যন্ত্রনির্ভর উপায়ে শৈবালের দেহ থেকে জলীয় অংশ আলাদা করতে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয় তা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। আমাদের দেশে রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত ও উপকূলীয় অঞ্চলের বালি, পাথর, শিলা ও কর্দমাক্ত ভিজা মাটি শৈবাল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ভৌগোলিকভাবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। শৈবালের উপকারিতা বহুমুখী। কারণ এই সুপার ফুড পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, কপার, জিংক, কোবাল্ট, আয়োডিন। এ ছাড়া আরও অনেক ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য এই শৈবাল। স্পিরুলিনা শৈবাল দেহের হজম শক্তি বৃদ্ধি, রোগজীবাণু থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা এইডস প্রতিরোধে সহায়ক। স্পিরুলিনার শরবতও এরই মধ্যে রাজধানীতে অনেকেই খেয়েছেন। গবেষকদের মতে, ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় ৩৭৪ কিলো ক্যালরি শক্তি রয়েছে। ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই প্রোটিন। এ ছাড়া এতে উচ্চমাত্রায় লৌহ, পটাশিয়াম, জিংক ও ক্যালসিয়াম রয়েছে। গবেষকরা বলছেন এই স্পিরুলিনা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই খেতে পারেন। সামুদ্রিক শৈবাল থেকে 'সি হুড মিল্ক শ্যেক' নামে এক ধরনের খাবার তৈরি করা হয়, যা নাশতা ও ভাতের বিপরীতে খাওয়া যায়। শৈবালের ৫টি প্রজাতি থেকে গাড়ি ও বিদু্যতের জ্বালানি হিসেবে বায়োফুয়েল, বায়োইথানল, বায়োহাইড্রোকার্বন, বায়োহাইড্রোজেন ইত্যাদি জ্বালানি পাওয়া যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে