বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

মহাশূন্যে মহাকাশের আবর্জনা

মহাকাশে ৪০টিরও বেশি আবর্জনার টুকরো রয়েছে যেগুলোর ওজন তিন টনেরও বেশি হবে। আর এ আবর্জনাগুলো সচল থাকা যেকোনো স্যাটেলাইটে সহজেই যেকোনো ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। মহাকাশের এসব আবর্জনা দূর করতে বিজ্ঞানীরা তাই এখন ওঠে-পড়ে লেগেছেন। 'ডারপা'র মতে, আবর্জনা ধরার জন্য হারপুন, জাল বা ছাতার মতো যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে, যার উদ্দেশ্য হবে আবর্জনাগুলোকে আরও বেশি করে পৃথিবীর দিকে ঠেলে দেওয়া কিংবা আরও উঁচু কোনো নিরাপদ কক্ষপথে ঠেলে দেওয়া
প্রদীপ সাহা
  ১১ মে ২০২৪, ০০:০০
মহাশূন্যে মহাকাশের আবর্জনা

পৃথিবীর কক্ষপথে অসংখ্য স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ঘুরে বেড়াচ্ছে- বিজ্ঞানের এই যুগে এ কথা এখন আর কারো অজানা নেই। এর গাণিতিক হিসাবটিও হয়তো অনেকেই জানেন- প্রায় এক হাজার। তাছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস। তবে মহাকাশে থাকা এগুলো সবই কাজের জিনিস এতে কোনো দ্বিমত বা সন্দেহ নেই। তবে এসব কাজের জিনিসের ভিড়ে কিছু অকাজের জিনিসও মহাকাশে ঘুরাফেরা করছে, যা সত্যিকার অর্থে ব্যাপক সমস্যা তৈরি করছে। অচল স্যাটেলাইট বা রকেটের ধ্বংসাবশেষগুলোই হচ্ছে মহাকাশের আবর্জনা। বিজ্ঞানীরা মহাকাশের এ আবর্জনার বিষয়টি নিয়ে এতদিন তেমন একটা ভাবেননি। তবে যেভাবে মহাকাশে আবর্জনার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তাতে তারা এখন গভীরভাবে এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। মহাকাশে আবর্জনার খবরা-খবর বা হিসাব রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে 'ইউএস স্পেস সার্ভিলেন্স নেটওয়ার্ক'। সাধারণত এ নেটওয়ার্কটি যেসব ময়লার ব্যস ও দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটারের মতো হয়, সেগুলোই চিহ্নিত করতে পারে।

বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী ২০০৬ সালে এ ধরনের আবর্জনার সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। আর বর্তমানে এ আবর্জনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরে মহাকাশে প্রায় ৬ হাজার নতুন আবর্জনার জন্ম হয়েছে। অন্য একটি হিসাবে দেখা যায়, মহাকাশে প্রায় ২২ হাজার ময়লার টুকরো রয়েছে, যেগুলো পৃথিবী থেকেই দেখা যায়। মহাকাশে অল্প সময়ে এত দ্রম্নত আবর্জনা বৃদ্ধির ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা ২০০৭ এবং ২০০৯ সালের দুটি দুর্ঘটনার কথা উলেস্নখ করেছেন। এর মধ্যে প্রথম দুর্ঘটনাটিকে বলা যায় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত। কারণ ২০০৭ সালে চীন তাদের তৈরি একটি অ্যান্টি-স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেটিকে আরেকটি অচল স্যাটেলাইটের দিকে ছুড়ে মেরেছিল। আর এর ফলে ওই ক্ষেপণাস্ত্র ও স্যাটেলাইট প্রায় দেড় লক্ষ টুকরোয় পরিণত হয় এবং

তারপর থেকে সেগুলো মহাকাশেই থেকে যায়। এই টুকরোর অনেকগুলোই আকারে এত ছোট ছিল যে, সেগুলো সহজে কারো চোখে পড়েনি। এমনকি চোখে পড়েনি 'ইউএস স্পেস সার্ভিলেন্স নেটওয়ার্ক'র। অন্যদিকে ২০০৯ সালে সচল একটি কমিউনিকেশন্স স্যাটেলাইট এবং রাশিয়ার একটি অচল স্যাটেলাইটের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আর এ সংঘর্ষের ফলেও তৈরি হয় অসংখ্য আবর্জনা।

মহাকাশের এসব আবর্জনার বিষয়ে কাজ করছেন নাসা'র সাবেক বিজ্ঞানী ডোনাল্ড কেসলার। ১৯৭৮ সালে এক প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, মহাকাশে একটি ময়লার উপাদান আরেকটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আবর্জনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের 'ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল'র পক্ষ হয়ে তিনি একটি গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ গবেষণায় মহাকাশের আবর্জনার বিষয়ে নাসাকে ব্যাপক সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মহাকাশ ক্রমেই স্পেসক্রাফট বা মহাকাশযানের চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং এতে ভয়ংকর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আর এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নাসাকে খুব শিগগিরই কৌশল ঠিক করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ময়লার টুকরোগুলো ঘণ্টায় ১৭ হাজার মাইল বেগে মহাবিশ্বের চারদিকে ঘুরছে এবং এগুলো যদি কোনো মহাকাশযানে গিয়ে আঘাত করে, তাহলে স্পেসক্রাফট বা মহাকাশযান ফুটো বা ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। যেমন- একবার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস অল্পের জন্য ময়লার টুকরোর সঙ্গে সংঘর্ষের হাত থেকে বেঁচে যায়। সেসময় আইএসএস-এ মোট ছয়জন নভোচারী ছিলেন। ঘটনা বুঝতে পেরে তারা কোনোরকমে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পরে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন।

গবেষণায় বলা হয়েছে, মহাকাশে ৪০টিরও বেশি আবর্জনার টুকরো রয়েছে যেগুলোর ওজন তিন টনেরও বেশি হবে। আর এ আবর্জনাগুলো সচল থাকা যেকোনো স্যাটেলাইটে সহজেই যেকোনো ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। মহাকাশের এসব আবর্জনা দূর করতে বিজ্ঞানীরা তাই এখন ওঠে-পড়ে লেগেছেন। পেন্টাগনের বিজ্ঞান বিষয়ক থিংক-ট্যাঙ্ক 'ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি' সংক্ষেপে 'ডারপা' মহাকাশের এ আবর্জনা সরানোর জন্য একটি পরামর্শ দিয়েছে, যা বিজ্ঞানীরা ভেবে দেখছেন। 'ডারপা'র মতে, আবর্জনা ধরার জন্য হারপুন, জাল বা ছাতার মতো যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে, যার উদ্দেশ্য হবে আবর্জনাগুলোকে আরও বেশি করে পৃথিবীর দিকে ঠেলে দেওয়া কিংবা আরও উঁচু কোনো নিরাপদ কক্ষপথে ঠেলে দেওয়া। বর্তমান আইন অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের ফেলে দেওয়া স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে পারে না। এক্ষেত্রে এসব আবর্জনা পরিষ্কারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন পরিবর্তনেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ময়লা-আবর্জনা নিঃসন্দেহে সবার কাছেই অপছন্দের একটি বিষয়- এ কথা নতুন করে বলার কিছুই নেই। কারণ এ ময়লা-আবর্জনা থেকে যেমন দুর্গন্ধ ছড়ায়, তেমনি সহজে ছড়িয়ে পড়ে রোগ-জীবাণু। আর মহাকাশেও জমতে শুরু করেছে আবর্জনা। জমে থাকা এসব ময়লা-আবর্জনা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে মহাকাশ ক্রমেই স্পেসক্রাফট বা মহাকাশযানের চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং ভয়ংকর দুর্ঘটনারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। কাজেই মহাকাশের এ আবর্জনা দ্রম্নত পরিষ্কার করতে হবে, সরাতে হবে সব জঞ্জাল। তা না হলে সচল থাকা যেকোনো স্যাটেলাইটে সহজেই যেকোনো ধরনের সমস্যা তৈরি হবে, ঘটে যাবে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা- এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে