শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

আবেগ পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত করে

কিছু কিছু আবেগ রয়েছে যেগুলো পরিবেশের বা সাংস্কৃতিক বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে নির্ভর করে মস্তিষ্কের গঠন বা হার্ডওয়্যারের ওপর। মস্তিষ্কের নিউরন দ্বারা গঠিত সার্কিট এ ইমোশনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। আর বেসিক ইমোশনের সঙ্গে জড়িত এ সার্কিটগুলো তৈরি করে বা সক্রিয় করে জিন বা জিনগোষ্ঠী। বেসিক ইমোশনের সঙ্গে জড়িত জিনগুলো বংশ থেকে বংশান্তরে মানুষ সঞ্চারিত করে। পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত হতে গিয়ে যে বৈশিষ্ট্যগুলো জীবের মাঝে সৃষ্টি হয় তা নতুন জেনেটিক বিন্যাস বা প্যাটার্নের উৎস
সোরিয়া রওনক
  ০৪ মে ২০২৪, ০০:০০
আবেগ পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত করে

মস্তিষ্কের চিন্তা ও কার্যক্রমকে প্রভাবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বোধ ও তা উপলব্ধির সৃষ্টি করে আবেগ। সেই বোধ বা উপলব্ধি অনুযায়ী আচরণ করে জীব। এ বোধ বা উপলব্ধি থেকে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরিকল্পনা করে মানুষ সে অনুযায়ী আচরণ করে মানুষ। এ বোধ বা উপলব্ধি সৃষ্টিতে অনেক সময় একটি একক আবেগ কাজ করে, আবার অনেক সময় অনেক আবেগের মিশ্রণ কাজ করে। যেমন প্রেম আবেগটি এককভাবে প্রেমের বোধ সৃষ্টি করে। আবার নৈতিকতাবোধ কাজ করে সিমপ্যাথি গিল্প আর গ্রাইভের মতো আবেগগুলোর সমন্বয়ে। কেন একটি চুক্তি অথবা নিয়ম মানার ক্ষেত্রে নৈতিকতা বোধ আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে? এভাবে আমাদের বোধ তৈরি এবং বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবিলায় আবেগগুলো তার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে অথবা কয়েকটি আবেগ পরস্পরের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে কাজ করে। আবেগ আমাদের পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত হতে সাহায্য করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করে টিকে থাকতেও সাহায্য করেছিল এ আবেগ।

আবেগের প্রকারভেদ এবং সংখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এ-সংক্রান্ত কিছু তথ্য বাস্তবিক অভিজ্ঞতার আলোকে পরীক্ষিত হওয়ায় জনপ্রিয় হয়েছে। গবেষক ডিলন ইভানস তার ইমোশন গ্রন্থে বিশেষভাবে তিন শ্রেণির ইমোশনের কথা উলেস্নখ করেছেন। এগুলো হলো বেসিক ইমোশন (ইধংরপ ঊসড়ঃরড়হ), হায়ার কগনিটিভ ইমোশন (ঐরমযবৎ ঈড়মহরঃরাব ঊসড়ঃরড়হ) এবং কালচারালি স্পেসিফিক ইমোশন (ঈঁষঃঁৎধষষু ঝঢ়বপরভরপ ঊসড়ঃরড়হ)।

বেসিক ইমোশনের ধারণা মনোবিজ্ঞানী পল একম্যানের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে। একম্যান দেখান কিছু কিছু আবেগ রয়েছে যেগুলো পরিবেশের বা সাংস্কৃতিক বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে নির্ভর করে মস্তিষ্কের গঠন বা হার্ডওয়্যারের ওপর। মস্তিষ্কের নিউরন দ্বারা গঠিত সার্কিট এ ইমোশনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। আর বেসিক ইমোশনের সঙ্গে জড়িত এ সার্কিটগুলো তৈরি করে বা সক্রিয় করে জিন বা জিনগোষ্ঠী। বেসিক ইমোশনের সঙ্গে জড়িত জিনগুলো বংশ থেকে বংশান্তরে মানুষ সঞ্চারিত করে। পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত হতে গিয়ে যে বৈশিষ্ট্যগুলো জীবের মাঝে সৃষ্টি হয় তা নতুন জেনেটিক বিন্যাস বা প্যাটার্নের উৎস। ডিএনএ অণুতে থাকা জিনগুলো কোনো বিন্যাস বা প্যাটার্নে সক্রিয় হবে তা শিক্ষার মধ্য দিয়ে জীব অর্জন করে। এ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত প্রয়োজনীয় বা গুরুত্বপূর্ণ বিন্যাসগুলো পরবর্তী বংশে সঞ্চারিত হয়। আবেগের সঙ্গে জড়িত বৈশিষ্ট্যগুলো জীবের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে এ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী জিনগুলো জীব-পরবর্তী বংশে সঞ্চারণের চেষ্টা করে। এভাবে দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় বেসিক ইমোশনগুলো মানুষসহ বেশ কিছু জীবের মধ্যে জেগে উঠেছে। বেসিক ইমোশনের অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ভয়। বিপজ্জনক বস্তু বা পরিস্থিতি এলে ভয় পেতে হবে এবং এ ভয় পাওয়া বা ভয়ের আবেগ সক্রিয় হওয়ার ফলে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বেসিক ইমোশনগুলোর প্রতিক্রিয়ায় জীব স্বয়ংক্রিয় আচরণ করে। মস্তিষ্কের তিনটি ভাগ নিম্ন মস্তিষ্ক, মধ্য মস্তিষ্ক আর উচ্চ মস্তিষ্কের কোনটি বেসিক ইমোশনের সঙ্গে জড়িত? পল একম্যান বলেন, বেসিক ইমোশনগুলো যেহেতু স্বয়ংক্রিয় আচরণের সঙ্গে জড়িত, তাই এ ইমোশনগুলোর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে নিম্ন মস্তিষ্ক।

বেসিক ইমোশন ছাড়াও আরেক ধরনের ইমোশন রয়েছে। এ নতুন ধরনের ইমোশনের বিষয়ে ধারণা দেন বেশ কিছু বিজ্ঞানী। তারা দেখান যে, কিছু ইমোশন উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমরা কালচার বা সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিই। যেমন বাংলা নববর্ষ, একুশে ফেব্রম্নয়ারি একজন বাঙালিকে আবেগাপস্নুত করে তা অন্য কোনো জাতির মানুষকে করবে না। অন্য কোনো জাতির মানুষ যখন এই বাঙালি কালচার বা সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাবে তখন সে এ আবেগকে বুঝবে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজের মধ্যে অনুভবও করবে। এ ধরনের আবেগকে বলে কালচারালি স্পেসিফিক ইমোশন।

কালচারালি স্পেসিফিক ইমোশন এসেছে আবেগের সাংস্কৃতিক সূত্র (ঞযব ঈঁষঃঁৎধষ :যবড়ৎু ড়ভ ঊসড়ঃরড়হ) থেকে। এ সূত্র যারা সমর্থন করেন তারা মনে করেন আবেগগুলো হচ্ছে শিক্ষার ফলে প্রাপ্ত আচরণ। কোনো কিছু শিখলে মস্তিষ্কে প্রোথিত হয় স্মৃতি হিসেবে। এ স্মৃতিগুলো পরে নতুন আচরণে ভূমিকা রাখে। তেমনি কালচার বা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত স্মৃতিগুলো আচরণে ভূমিকা রাখে বা আবেগ প্রদর্শনে সাহায্য করে। আবেগের সাংস্কৃতিক সূত্র বলে, আবেগ সঞ্চারিত হয় কালচারের মাধ্যমে যেমনটা ভাষা সঞ্চারিত হয়।

কালচারালি স্পেসিফিক আবেগকে শুধু ইনট (রহহধঃব) হলে চলে না, সঙ্গে লাগে বিশেষ কিছু শর্ত বা পরিস্থিতি। এ শর্ত বা পরিস্থিতিগুলো কালচার বা সংস্কৃতি থেকে আসে।

কোনো শিশুকে ভাষা শিখতে হলে ভাষা শুনতে হবে। সে যে ভাষা শিখবে সেই ভাষার মানুষের মধ্যে থাকতে হবে। শিশুর মধ্যে ভাষাসংক্রান্ত থাকা জিনগুলো শিশুকে ভাষা শিখতে সাহায্য করে। এ জিনগুলো না থাকলে শিশু ভাষা শিখতে পারে না। তবে শুধু জিনগুলো থাকলেই হবে না। জিনগুলোকে নির্দিষ্ট বিন্যাসে সক্রিয় হয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিশেষ পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারিত হয় সে কীভাবে কোন ভাষা শিখবে। বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে থাকলে বাংলা ভাষা শিখবে। ইংরেজি ভাষাভাষীদের মধ্যে থাকলে ইংরেজি ভাষা শিখবে।

কালচারালি স্পেসিফিক আবেগও এ রকম একটি বিষয়। কালচারালি স্পেসিফিক আবেগের ক্ষেত্রে যা হয়- আবেগসংক্রান্ত বেসিক ইমোশন রিলেটেড জিনকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ পরিস্থিতির সাপেক্ষে আবেগসংক্রান্ত আচরণ করে থাকে। এ বিশেষ পরিস্থিতি মানুষকে সে যে সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠে সেই সংস্কৃতির প্রকাশে সাহায্য করে থাকে।

কালচারালি স্পেসিফিক ইমোশনের সঙ্গে মিথ্যা আবেগের (ঋধষংব ঊসড়ঃরড়হ) যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। কীভাবে? যেকোনো ধারাবাহিক আচরণ (বাবহঃং) মানুষ করতে পারে যদি সে বিষয়টি ভালোভাবে সে শিখে নেয়। গবেষকরা বলছেন, কোনো একটি বিশ্বাস বা তত্ত্ব যদি আবেগত প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ধারাবাহিক আচরণের শর্ত আরোপ করে বা পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে এ পরিস্থিতিতে কালচারালি স্পেসিফিক আবেগ যেমন সক্রিয় হয় সে রকম ফলস ইমোশন বা মিথ্যা আবেগ সক্রিয় হয়।

বেসিক ইমোশন ও কালচারালি স্পেসিফিক ইমোশনের পাশাপাশি তৃতীয় আরেক ধরনের ইমোশন কাজ করে মানুষের মধ্যে। তা হলো হায়ার কগনিটিভ ইমোশন।

বিজ্ঞানী গ্রিফিথ তার গবেষণার ফলাফল হিসেবে হায়ার কগনিটিভ ইমোশনকে উপস্থাপন করেন। তিনি দেখান হায়ার কগনিটিভ ইমোশনে মস্তিষ্কের কর্টিক্যাল কার্যক্রম বেশি হয়। কর্টিক্যাল কার্যক্রম উচ্চ মস্তিষ্কের বিষয়বস্তু। উচ্চ মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কটেক্সে কর্টিক্যাল কার্যক্রম হয়। এভাবে হায়ার কগনিটিভ ইমোশন উচ্চ মস্তিষ্কের সঙ্গে জড়িত বিষয়বস্তু।

হায়ার কগনিটিভ ইমোশন দেখা যায় বেসিক ইমোশনের চেয়ে কম ইনটি (রহহধঃব) তবে কালচারালি স্পেসিফিক ইমোশনের চেয়ে বেশি ইনট (রহহধঃব)। গ্রিফিথ হায়ার কগনিটিভ ইমোশনের উদাহরণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন হায়ার কগনিটি ইমোশন প্রেমকে (খড়াব)। মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে জেগে ওঠা এ আবেগ সচেতন নানারকম ভাবনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আবেগ, যা বেসিক ইমোশন আর কালচারলি স্পেসিফিক ইমোশন থেকে একদম ভিন্ন।

জোসেফ লেডক্স মানুষের ভয় তথা জীবের ভয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। ভয় মস্তিষ্কে কীভাবে কাজ তা তিনি বের করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এটি করতে গিয়ে উন্মোচন করেছেন ভয়ের স্নায়বিক পথমালা। লেডক্স দেখান, ভয় মস্তিষ্কে দুটি পথে কাজ করে। একটি হচ্ছে প্রাথমিক বা প্রাইমারি পথমালা এবং অন্যটি উচ্চতর বা হায়ার পথমালা।

রাস্তায় পায়ের সামনে একটি সাপ দেখে ভয়ে আপনি দৌড়ে পালালেন। অর্থাৎ সাপ দেখার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আপনার মাঝে ভয় জেগে উঠল এবং আপনি দৌড়ে পালালেন। এ ঘটনাটা হচ্ছে ভয়ের প্রাথমিক পথমালার উদাহরণ।

অর্থাৎ নিম্ন মস্তিষ্কের সেনসরি থ্যালামাস সাপের ছবির তথ্য নিল বা ভয়ের উদ্দীপনা নিল সেই উদ্দীপনায় তথ্যকে উচ্চ মস্তিষ্কে বা সেরেব্রাল কর্টেক্সে না পাঠিয়ে নিম্ন মস্তিষ্কের ভেতরে রেখেই স্নায়বিক পথে অ্যামিয়াপলাত পাঠাল। অ্যামিগডালা প্রয়োজনীয় প্রসেসিং শেষে ভয়ের প্রতিক্রিয়া দেখাল। পুরো প্রক্রিয়াটি কয়েক সেকেন্ডে ঘটে থাকে। তবে প্রয়োজনীয় স্মৃতি শিক্ষা আর মনোযোগ থাকলে প্রাথমিক পথে নয় বরং উচ্চতর পথে ভয়ের অনুভূতি কাজ করে। তখন দেখা যায়, ভয়ের উদ্দীপনাকে সেনসরি থ্যালামাস প্রসেস করে উচ্চ মস্তিষ্কে পাঠায়। উচ্চ মস্তিষ্ক থেকে প্রসেস হয়ে ভয়ের তথ্য অ্যামিগডালায় যায়। অ্যামিগডালায় সর্বশেষ প্রসেস শেষে প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে