বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শব্দদ্বয় এই সমগ্র বিশ্বকেই কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে। বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। প্রতিটি সমস্যায় সমাধানের সূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যেই। বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম সমস্যা হলো খাদ্য সমস্যা। এর কারণ বহুমুখী। অসম বন্টন যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া। কিন্তু জমির পরিমাণ কমার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনও বেড়েছে সমানতালে। অথচ কৃষিতেই রয়েছে কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ। নারী-পুরুষ উভয়ই কর্মরত রয়েছেন কৃষিতে। কৃষিতে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। এই প্রযুক্তির একটি হলো জৈব প্রযুক্তি। জৈব প্রযুক্তি ধারণাটি নতুন নয়। বরং বিশ্বে উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে জৈব প্রযুক্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষি। সে হিসেবে কৃষি বাংলাদেশের প্রাণ। স্বাধীনতার পর থেকে গত পাঁচ দশকে কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। যার ফলস্বরুপ দেশের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এবং সেই সঙ্গে কৃষি জমির পরিমাণ কমলেও দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ফসল উৎপাদনের মূল হলো মাটি। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছে। মাটি ক্রমেই তার স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। অধিক পরিমাণ সারের ব্যবহার এই অবস্থাকে আরও তরাণ্বিত করছে। এখানে জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ, জৈব সার প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হয় এবং মাটির গুণাগুণ সুরক্ষিত রাখে। আবার বিপরীতে ফসল উৎপাদনেও ভূমিকা রাখে। জৈব সার হলো খনি থেকে প্রাপ্ত শিলার খনিজ এবং প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ উপকরণ থেকে তৈরি দ্রব্য। এতে রয়েছে পশুর মল, গুঁড়া করা শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সেল চূর্ণ, সূক্ষ্মভাবে গুঁড়া করা মাছ, ফসফেট শিলা এবং কাঠের গুঁড়ার মতো উপাদান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফসল উৎপাদনে যে সমস্যাগুলো সামনে এসেছে সেগুলো হলো- অল্প জমির বিপরীতে অধিক ফসল উৎপাদন করা, ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করার প্রয়োজনীয়তা, বন্যা ও খরা সহ্যক্ষমতা সম্পন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা, ফসলের আকার বৃদ্ধি করা, আকর্ষণীয় রং ও স্বাদ ইত্যাদি আরও অনেক চাহিদা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন এই চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কৃষিতে পরিবর্তন বাধ্যতামূলক। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঝরৎ অষনবৎঃ ঐড়ধিৎফ জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব থিম মাথায় রেখে ভারতে জৈব বিষয়ে কাজ করেন। এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে জৈব কৃষির জনক নামে অভিহিত করা হয়।
কৃষিকে কেন্দ্র করেই দেশের ঋতুচক্র আবর্তিত হয়। কৃষির গুরুত্ব তাই সর্বাধিক। বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনে উলেস্নখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশে। কৃষির এই বিপস্নবের পেছনে রয়েছে কৃষিতে বায়োটেকনোলোজি বা জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার। কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য বর্তমানে জৈব প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় উন্নত মানের বীজ ও চারা উৎপাদনের জন্য। বর্তমানে কয়েক প্রকার ধান চাষ করে থাকে এবং এর প্রত্যেকটি জৈব প্রযুক্তির অনুদান হিসেবে আখ্যায়িত। বয়োটেকনোলজি বা জৈব প্রযুক্তির কারণে কৃষি ক্ষেত্রে এসেছে অনেক বেশি উন্নয়ন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে প্রত্যেকটি কৃষক। সবার আগে বোঝা দরকার, জৈব প্রযুক্তিটা আসলে কী? জৈব প্রযুক্তি হলো বৈজ্ঞানিক এবং প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে জীবদের ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণকর ও ব্যবহারযোগ্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতি তৈরির বিশেষ প্রযুক্তি। এটি মূলত জীববিদ্যাভিত্তিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি কৃষি, খাদ্য বিজ্ঞান এবং ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত হয়। ১৯১৯ সালে হাঙ্গেরীয় কৃষি প্রকৌশলী কারোই এরাকি সর্বপ্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন। বাংলার প্রায় সবাই একসময় পেশা হিসেবে কৃষির ওপরই নির্ভর ছিল। এখনো কৃষিই অন্যতম প্রধান পেশা। চতুর্থ শিল্প বিপস্নবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গতি লাভ করলেও কৃষিরও আধুনিকায়ন ঘটার ফলে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে এই খাত। বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এসব খাতে। কৃষির বহুমুখীকরণের ফলে এই উন্নয়নের গতি তরাণ্বিত হয়েছে। কৃষির আধুনিকায়নের মাধ্যমে অর্থাৎ ই-কৃষির মাধ্যমে কৃষিসেবা আজ কৃষকের দোরগোড়ায়।
দেশের উন্নয়নে যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন আছে, সেভাবেই খাদ্য নিরাপত্তা প্রয়োজন সবার আগে। কৃষির উন্নয়ন না হলে খাদ্য নিরাপত্তা সম্ভব হবে না। একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা পেতে হলে কৃষির ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন কৃষি জমি রক্ষা করা। কারণ, শহরায়ন প্রক্রিয়ায় চাষযোগ্য জমি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে গ্রামগুলো শহরায়ন প্রক্রিয়া মূলত কয়েক দশক থেকেই শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে এর গতি একটু ধীর হলেও গত এক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। হারিয়েছি বহু নদী, খাল-বিল আর বিনিময়ে পেয়েছি নাগরিক জীবনের কিছু সুবিধা। তাই খুব দ্রম্নত দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে। এটি করতে হলে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার কার্যকর সমাধান হতে পারে। ১৯৯৬-২০০৫ সালে বিশ্বে বায়োটেক ফসলের চাষ ৫০ গুণ বেড়েছে এবং ৬টি দেশ থেকে ২১টি দেশে ৯০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ৮.৫ মিলিয়ন কৃষক চাষ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের ৫০ ভাগ বায়োটেক ফসল চাষ হয়। ১৪টি দেশ প্রত্যেকে ৫০ হাজার হেক্টর বা বেশি জমিতে বায়োটেক ফসল চাষ করছে। দেশগুলো হলো- আমেরিকা, চীন, আর্জেন্টিনা, কানাডা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, উরুগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, রোমানিয়া, মেক্সিকো, স্পেন ও ফিলিপাইন। বায়োটেক ফসলের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- গম, সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, তেলবীজ ফসল, শাকসবজি, ফল ইত্যাদি। প্রযুক্তির ক্রম বিবর্তনে আজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ বিবেচনায় আমাদের উৎপাদনের গতি বাড়াতে হবে। অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে এবং ফসলের গুণাগুণও বৃদ্ধি করতে হবে। এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার। বায়োটেক ফসল আমাদের পরিবেশের জন্য আরও টেকসই এবং উন্নত। জৈব প্রযুক্তিতে কম কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় এবং জমির কম খরচ দিয়ে অধিক ফসলের চাষ সম্ভব হয়, কৃষিক্ষেত্রগুলো জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে- যা মাটির স্বাস্থ্য এবং জল সংরক্ষণের উন্নতি করে। কৃষির সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে। বর্তমান সময় নিরাপদ খাদ্য সময়ের দাবি। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে, যার ৫৮ ধারায় বলা আছে যে 'মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য, কীটনাশক বা বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে।' অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে মানব স্বাস্থ্যেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। জৈব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করা হয়। বছরের পর বছর কৃষিকাজে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করে আমরা মাটির উপকারী অণুজীবগুলো মেরে ফেলেছি। সেই উর্বরতা শক্তি ফিরিয়ে আনতে হলে প্রাকৃতিক উপাদান প্রয়োগের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের কৃষি জমিতে ব্যাপক মাত্রায় জৈব উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। বছর-দুয়েক আগে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ৮০ শতাংশ কৃষির জৈব উপাদান কমে গেছে। যার ফলে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার, সেখানে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান দুই শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৫৬ শতাংশ জমিতে ফসলের আবাদ হয়। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে দেশের কৃষিজমিতে জৈব উপাদান কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অথচ ফসল উৎপাদন ঠিক রাখতে হলে মাটিতে জৈব উপাদান নূ্যনতম সাড়ে ৩ শতাংশ থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু দেশের ৭ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে জৈব উপাদান নেমে গেছে ১ শতাংশের নিচে। প্রায় ৪০ লাখ হেক্টর জমির জৈব উপাদান এখন ২ শতাংশের নিচে। ফলে মাটির উর্বরতা ঠিক রাখতে যে অণুজীব কাজ করে, তা সঠিক মাত্রায় কাজ করতে পারছে না। ইউরোপীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফআইবিএলের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত এক দশকে অর্গানিক কৃষিপণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ শতাংশ। অর্গানিক পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স। ১৬৪টি দেশে বর্তমানে সার্টিফায়েড অর্গানিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তাই একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অর্গানিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।