ভবিষ্যতের জ্বালানি বায়ো ডিজেল
বায়ো ডিজেল নতুন সময়ের জ্বালানি। ভবিষ্যতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখনো নানাভাবে হাতছানি দিচ্ছে বায়ো ডিজেল। বিজ্ঞানীরা বায়ো ডিজেলকেন্দ্রিক বিভিন্নরকম সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন।
প্রকাশ | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রায়হান শাহরিয়ার
বায়ো ডিজেল নতুন সময়ের জ্বালানি। ভবিষ্যতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখনো নানাভাবে হাতছানি দিচ্ছে বায়ো ডিজেল। বিজ্ঞানীরা বায়ো ডিজেলকেন্দ্রিক বিভিন্নরকম সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন।
শ্যাওলা বায়ো ডিজেল : শেওলামাত্রই তেলতেলে। তেল আছে বলেই তেলতেলে। এই তেলের উৎপাদন খরচ জাত্রোফার চেয়ে অনেক কম। জাত্রোফায় লাগে কয়েক মাস, সেখানে মাত্র দু-তিন দিনের মধ্যে জৈব তেল শুকনো শ্যাওলা থেকে জোগান দেওয়া সম্ভব। শ্যাওলা থেকে তেল উৎপাদনে জায়গা লাগে কম। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সমীক্ষায় জানা যায়, তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রে ১২১০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ তৈরিতে উৎপন্ন হয় ১৫ হাজার টন কার্বন ডাইঅক্সাইড, যার সবটুকু শুষে নেবে সেখানে বেড়ে ওঠা শ্যাওলা তার খাদ্য হিসেবে। ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমবে অন্যদিকে বিশ্ববাজারে কার্বন ক্রেডিটজনিত অর্থ আসবে রাষ্ট্রের কোষাগারে। জাত্রোফা বা কোনো শস্যবীজ থেকে শ্যাওলা ৩০ গুণ বেশি বায়ো ডিজেল দেবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। শুকনো শ্যাওলাকে পেষণ করলে মিলবে জৈব তেল। তিন ভাগের মধ্যে দুই ভাগ ডিজেল ও এতে এক ভাগ শ্যাওলার তেল দিলেই তৈরি হবে বায়ো ডিজেল।
নারিকেল তেল থেকে বায়ো ডিজেল
ইতাচাহি ওইয়াতকুলজোন ২০০১ সালের মার্চে নারকেল তেল থেকে উদ্ভাবিত জ্বালানির প্যাটেন্ট পান। তিনি ১৮ বছর ধরে ধাপে ধাপে একে উন্নত করেছেন। তেলের ফর্মুলা নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন বটে, কিন্তু স্থানীয় কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করে দিয়েছেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের প্রয়োজনীয় জ্বালানি উৎপাদন করতে পারে। ২০ ভাগ অপরিশোধিত নারিকেল তেল ও এক ভাগ কেরোসিন মিশিয়ে এই জ্বালানি তৈরি করা হয়। এটি উৎপাদনের প্রযুক্তি খুব সহজ। অনুন্নত ও ধীরগতির যন্ত্রপাতিতে এটি ব্যবহার করা যায়। থাইল্যান্ডের রাজাও পাম তেল থেকে উৎপাদিত বায়ো ডিজেলের প্যাটেন্ট পেয়েছেন। তিনি ২০ বছর গবেষণা করে এটি আবিষ্কার করেন। থাইল্যান্ডের কৃষক ও ফেরিচালকরা এটি ব্যবহার করছে। তারা প্রতিদিন ৭০ হাজার লিটার অপরিশোধিত ভেজিট্যাবল অয়েল থেকে তৈরি বায়ো ডিজেল কিনছে। এর মূল্য প্রচলিত ডিজেলের তুলনায় অনেক সস্তা। লিটারপ্রতি ৪-৬ সেন্ট। এটি প্রচলিত ডিজেল থেকে শতকরা ৩০ ভাগ কম কালো ধোঁয়া উৎপন্ন করে।
সাদা মান্দার গাছ থেকে বায়ো ডিজেল : সাদা মান্দারের বৈজ্ঞানিক নাম জাত্রোফা কারকাস (ঔধঃৎড়ঢ়যধ পধৎপঁং)। এর বাংলা নাম ভেরেন্ডা। এর ১৭৫টি জাত রয়েছে। এর মধ্যে জাত্রোফা কারকাস থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন সম্ভব। জার্মানি থেকে অধ্যাপক ড. কে বেকার এ দেশে এসে এই জাতটি শনাক্ত করে যান। ২০০৭ সালে গোল্ডম্যান স্ক্যাস জাত্রোফাকে ভবিষ্যৎ জৈব জ্বালানির প্রধান উৎস বলে ঘোষণা দেন। ভালো জাতের ভালো বীজ থেকে ৩৪.৪%-৪০% তেল নিষ্কাশন সম্ভব। তবে জাত্রোফা নিয়ে গবেষণা নিতান্ত অপ্রতুল। এ পর্যন্ত যা হয়েছে, তা হলো : প্রতি হেক্টর জমি থেকে ১০-১২ টন পর্যন্ত বীজ পাওয়া সম্ভব, যা থেকে ২.৫-৩ হাজার লিটার বায়ো ডিজেল পাওয়া যাবে। টাইম ম্যাগাজিনের জরিপ থেকে জানা যায়, একরপ্রতি বছরে সাত হাজার ৩০০ লিটার বায়ো ডিজেল নিষ্কাশন সম্ভব। হ্যারি স্টাউরটনের মতে, জাত্রোফা পতিত জমিতে জন্মায়। একে অর্থকরী ফসল যেমন- কফি, চিনি, ফলমূল ও শাক-সবজির সারিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড ঘোষণা দিয়েছে, ২০১৩-এর মধ্যে তারা তাদের মোট জ্বালানির ১০% জৈব জ্বালানি ব্যবহার করবে। তাদের উৎপাদিত বায়ো ডিজেল ব্যারেলপ্রতি ৪৩ ডলার, যেখানে অপরিশোধিত তেলের মূল্য ১২২.৩০ ডলার। এই উদ্ভিদটি (জাত্রোফা কারসা) বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- ফিজাক নাট, পিনোসিলো, হার-ইল-মিলুক ইত্যাদি। তেল নিষ্কাশনের পর বাকি অংশটুকু ডাইজেস্টার, বায়োগ্যাস, সার, পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মুম্বাই ও দিলিস্নর রেললাইনের দুই পাশে লাগানো আছে জাত্রোফা গাছ এবং এই রাস্তায় ট্রেন ১০% জাত্রোফা তেলে চলে।
কলা থেকে বিদু্যৎ :অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে ২০ হাজার টনেরও বেশি কলা বাজারে যাওয়ার সুযোগ পায় না। আর এই কলা থেকে বিদু্যৎ তৈরির স্বপ্ন দেখছেন ডক্টর ক্লার্ক। তিনি ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের লেকচারার। তিনি সিলকৃত পাত্রে কলা পচিয়ে মিথেন গ্যাস তৈরি করে ওই গ্যাস দিয়ে টারবাইন চালিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন করেছেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাখা, হিটার ইত্যাদি ৩০ ঘণ্টা চালাতে ৬০ কেজি কলা প্রয়োজন।
কাঠ থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন : মেশিনের হপারে ছোট ছোট কাঠের টুকরা দিয়ে ভর্তি করে ঢাকনা বন্ধ করা হয়। এতে বায়ু এমনভাবে প্রবেশ করানো হয়, যাতে কাঠ না পুড়ে গ্যাসিফাই হয় অর্থাৎ কার্বন মনোঅক্সাইড হয়। গ্যাস ফিল্টারে নিয়ে পানির মাধ্যমে ঠান্ডা করা হয়। এখানে গ্যাস ও বাতাসের মিশ্রণ করা হয়। মিশ্রণটি ডিজেল ইঞ্জিনে নেওয়া হয়। ডিজেল ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণের জন্য গভর্নর আছে। গ্যাস আসা শুরু হলে গভর্নর ডিজেল আসাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমিয়ে দেয়। গ্যাস ইঞ্জিনকে সচল করে। ইঞ্জিনের এই শক্তিকে জেনারেটরে নিয়ে বিদু্যৎ উৎপন্ন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কয়লা, আলু, কাঠের গুঁড়া ও তুষ থেকে বিদু্যৎ উৎপন্ন করা যায়।
এই প্রক্রিয়ায় ১ কিলোওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন করতে এক কেজি কাঠ দরকার হয়। গ্যাসিফাইয়ের মাধ্যমে ২০০ কিলোওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন সম্ভব।
মূত্র থেকে বিদু্যৎ : সিঙ্গাপুরের বিজ্ঞানী কি ব্যাংলি ও তার সহযোগীরা মূত্রশক্তিসম্পন্ন পেপার ব্যাটারি তৈরি করেছেন। প্রথমে তারা একটি কাগজের টুকরাকে কপার ক্লোরাইডে ডুবিয়ে, ম্যাগনেসিয়াম ও কপারের স্ট্রিপের মধ্যে স্যান্ডউইচের মতো করে স্থাপন করেন। এরপর তারা দুই শিট পস্নাস্টিক দিয়ে পেপার ব্যাটারিটি মুড়িয়ে ফেলেন। পস্নাস্টিকের ফাঁক দিয়ে ফুটো ফুটো করে মূত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ফলে সেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদু্যৎ উৎপন্ন হতে দেখা গেল। এখানে ম্যাগনেসিয়াম স্তর ব্যাটারির অ্যানোড ও কপারের স্তরটি ক্যাথোড অর্থাৎ ঋণ হিসেবে কাজ করে। এতে তারা বুঝতে পারেন, মূত্রে বিদু্যতায়িত পরমাণু রয়েছে।