শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়াবহতা হচ্ছে নিজের পোষক পরিবর্তনের ক্ষমতা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক
  ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়াবহতা হচ্ছে নিজের পোষক পরিবর্তনের ক্ষমতা

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস অর্থোমিক্সোভিরিডি পরিবারের একটি ভাইরাস। ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সাল সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। ভয়াবহ এই মহামারিকে 'স্প্যানিশ ফ্লু' বলে। এই ভাইরাসের রয়েছে বিভিন্ন রূপ। মানুষ, পাখি, শূকর প্রভৃতি জীব প্রজাতিকে নিজের পোষকরূপে ব্যবহার করতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষমতা হচ্ছে নিজের পোষক পরিবর্তনের ক্ষমতা। নতুন পোষক প্রজাতীতে ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা না থাকায় সেটি দ্রম্নত শরীরে স্থান করে নেয়, প্রজাতির অন্য সদস্যদের আক্রান্ত করে এবং পোষকের মৃতু্যর কারণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।

তিন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- টাইপ 'এ', 'বি' ও 'সি'। টাইপ এ পাওয়া যায় পাখি, শূকর, ঘোড়া এবং সীলের। এগুলোর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা 'এ' সবচেয়ে ভয়ংকর। বিশ্বব্যাপী ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাস কয়েকটি মহামারির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা 'বি' ভাইরাস মাঝে মধ্যে কিছু মহামারির জন্য দায়ী হলেও ইনফ্লুয়েঞ্জা 'সি' ভাইরাস তেমন ক্ষতিকর নয়।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ভিরিয়ন গোলাকার, ব্যাস ৮০-১২০ ন্যানোমিটার। এর গঠনে মোট ৯টি প্রোটিন আছে। সামগ্রিকভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কণিকার ১% আরএনএ, ৭৩% প্রোটিন, ২০% লিপিড ও ৬% কার্বোহাইড্রেট (শর্করা)। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কণিকা একটি আবরণ বা এনভেলপ দ্বারা আবৃত থাকে।

ভাইরাসের প্রোটিনগুলোর মধ্যে তিনটির আরএনএর সঙ্গে যুক্ত থাকে, এগুলোকে রাইবো নিউক্লিয়প্রোটিন/আরএনপি বলা হয়। তিনটি বৃহৎ প্রোটিন এই আরএনপিগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকে। ম্যাট্রক্স প্রোটিন গ১ ভাইরাসের এনভেলপের নিচে ম্যাট্রিক্স গঠন করে। বাকি দু'টি প্রোটিন হিমাগস্নুটিনিন ও নিউরামিনিডেজ ভাইরাসের এনভেলপ ভেদ করে বাইরের দিকে উন্মুক্ত থাকে।

হিমাগস্নুটিনিনের ওপর ভিত্তি করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে ১৫ হিমাগস্নুটিনিন ভাইরাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটির সাহায্যেই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তার পোষক কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্যদিকে জীবের ইমিউনসিস্টেম প্রধানত এই হিমাগস্নুটিনিন প্রোটিনের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি করে। যেই দেহে হিমাগস্নুটিনিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি আছে তার দেহে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রবেশ করলে অ্যান্টিবডি হিমাগস্নুটিনিন দেহে কোষ প্রবেশে বাধা দেয়।

টি সাবটাইপে (ঐ১-ঐ১৫) ভাগ করা হয়। এগুলোকে করা হয় ঐ১, ঐ২ এভাবে চিহ্নিত করা হয়। ওহভষঁবহুধ ঞুঢ়ব অ ঐ৫ লিখলে বুঝতে হবে ভাইরাসটি ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ এ এবং এর সবটাইপ হিমাগস্নুটিনিন নম্বর ৫।

নিউরামিনিডেজ একটি এনজাইম। এটির সাহায্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পোষক কোষ থেকে সংখ্যাবৃদ্ধির পরে বেরিয়ে আসে। নিউরামিনিডেজের ওপর ভিত্তি করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে মোট ৯টি সাবটাইপ (ঘ১-ঘ৯) করা হয়। কোন ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাসের সাবটাইপ নিউরামিনিডেজ ১ হলে তাকে লেখা হয় ওহভষঁবহুধ অ ঘ১. মানুষের মধ্যে পাওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসগুলোতে চারটি হিমাগস্নুটিনিন (ঐ১, ঐ২, ঐ৩ ও ঐ৫) ও দু'টি নিউরামিনিডেজ (ঘ১ ও ঘ২) পাওয়া গেছে।

এর নিউক্লিক এসিড এক সূত্রক আরএনএ। ভাইরাসটির আরএনএ মোট আটটি খন্ড বিশিষ্ট এবং নেগেটিভ সেন্স। জিনোমের আকার ১৩.৬ কিলো বেস পেয়ার।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষ অথবা প্রাণীর হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে নির্গত কণার দ্বারা ছড়ায়। এই কণাগুলোকে ড্রপলেটও বলা হয়। কারণ এগুলোর ব্যাস প্রায় ১০ মাইক্রোমিটার হয়ে থাকে। ছোট ছোট এই কণাগুলো বাতাসে ভাসতে পারে এবং এভাবেই আশপাশের মানুষ বা প্রাণীকে আক্রান্ত করে।

ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণগুলোকে দু'টি ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথমত, কাঁপুনি, মাথাব্যথা ও শুকনো কফ শুরু হয়। এর ফলে উচ্চ জ্বর, পেশিতে ব্যথা, খারাপ লাগা, অস্থির লাগা এগুলো শুরু হয়। প্রায় ৩ দিন ধরে জ্বর থাকে, শ্বসননালির সমস্যাগুলো প্রায় সপ্তাহব্যাপী থাকে। ব্যক্তি ভেদে ১ থেকে ৩ সপ্তাহ ধরে দুর্বল লাগতে পারে। শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েরই একই সমস্যা দেখা যায়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি জ্বর ও বমি থাকতে পারে। প্রায় ১২% শিশুর কানে ব্যথা হয়।

দ্বিতীয়ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা নিউমোনিয়া পর্যায়ে গড়াতে পারে। সাধারণত যাদের অনেক দিন ধরে কোনো রোগ আছে বা গর্ভবতী মহিলারা অধিক আক্রান্ত হন। অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরাল নিউমোনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক্টেরিয়াল নিউমোনিয়াও হতে পারে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস মানুষ, পাখি, শূকর, সীল প্রভৃতি প্রাণীতে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা প্রাণীতে তেমন রোগ করতে পারে না। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তার জিনোমে পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন রূপ নিতে পারে। সাধারণত দুই পদ্ধতিতে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জিনোমে পরিবর্তন আসে। প্রথমত, অ্যান্টিজেনিক সিফট ও দ্বিতীয়ত অ্যান্টিজেনিক ড্রিফট।

ব্যাক্টেরিয়াঘটিত রোগ-প্রতিরোধের জন্য যেমন অ্যান্টিবায়োটিক আছে সেরকম কোনো অ্যান্টিভাইরাস ভাইরাসজনিত রোগের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অল্প কিছু ওষুধ আছে যারা ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে লড়তে শরীরকে সাহায্য করতে পারে। যেমন- ওসেলটামিভির ও যানামিভির।

ওসেলটামিভির : ওসেলটামিভির একটি নিউরামিনিডেজ ইনহিভিটর। এটি নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে পোষক কোষ থেকে বের হতে দেয় না। জার্মানির

বিখ্যাত রচ (জড়পযব) ওষুধ কোম্পানি ওসেলটামিভিরকে টামিফ্লু নামে বাজারজাত করে থাকে।

যানামিভির : ওসেলটামিভিরের মতো যানামিভিরও একটি নিউরামিনিডেজ ইনহিভিটর। এটিকে রেলেঞ্জা নামে বাজারজাত করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে