যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রম্নতগামী যানবাহন উড়োজাহাজ বা বিমান। দেশের বাইরে কিংবা দেশের ভেতরে খুব কম সময়ে যাওয়ার জন্য শৌখিন মানুষের প্রথম পছন্দ এটি। এই বিমান বা উড়োজাহাজের উদ্ভাবক দুই ভাই সম্পর্কে কমবেশি সবাই বিদিত আছেন। রাইট ব্রাদার্স উইলবার রাইট এবং অরভিল রাইট পৃথিবীর বুকে প্রথম উড়োজাহাজ উদ্ভাবন করেন। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়, অরভিল রাইট ১৮৭১ সালের ১৯ আগস্ট ওহিইও'র ডেটন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ওই শহরে মৃতু্যবরণ করেন। অপরদিকে উইলবার রাইট ১৮৬৭ সালের ১৬ এপ্রিল আমেরিকার মিলভনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯ ৯২ সালের ৩০ মে ওহইিও এর ডেটন শহরে মৃতু্যবরণ করেন। দুই ভাই পেশায় ছিলেন মার্কিন প্রকৌশলী, যাদের উড়োজাহাজ উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তাদের বাবা মিল্টন রাইট গির্জার ধর্মযাজক ছিলেন। ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর তারাই প্রথম পৃথিবীর বুকে সংযত, শক্তিশালী এবং বাতাসের চেয়ে বেশি ওজনবিশিষ্ট, উদ্বেগহীন, মানুষ বহন করা যায় এমন একটি উড়োজাহাজ তৈরি করেন। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোয়াইট ডি. আইজেন ১৯৫৯ সালে ১৭ ডিসেম্বর দিনটিকে রাইট ব্রাদার্স দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। আমেরিকানরা বেশ ঘটা করেই এই দিবসটি পালন করে থাকে। তবে দিবসটি কোনো সরকারি ছুটির দিন নয়।
ধর্মযাজক মিল্টন রাইটের পাঁচ ছেলে-মেয়ে। তার মধ্যে উইলবার রাইট ছিলেন বড় এবং অরভিল রাইট ছিলেন ছোট। বড় ছেলে উইলবার রাইট মাত্র ৪৫ বছর জীবিত ছিলেন। পেশায় ছিলেন প্রকাশক ও বাইসাইকেল বিক্রেতা। আর ছোট ছেলে অরভিল রাইট ৭৬ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনিও পেশায় ছিলেন প্রকাশক এবং বাইসাইকেল বিক্রেতা। ধর্মযাজক মিল্টন রাইটের দুই ছেলে বাল্যকাল থেকে অত্যন্ত মেধাবী, আবিষ্কার-মনস্ক এবং চিরকুমার ছিলেন। ব্যস্ততার কারণে তাদের দু'জনের বিয়ে করা সম্ভব হয়নি। মিল্টন রাইট একদিন তার দুই ছেলেকে একটি খেলনা হেলিকপ্টার কিনে দিয়েছিলেন। সেটির নকশা করেছিলেন হেলিকপ্টার উদ্ভাবক ফ্রান্সের আলফোন্স পে। সেটা দেখে তার দুই ছেলে নতুন একটি হেলিকপ্টার তৈরি করেন। উড়োজাহাজ বানাতে এই দুই ভাই সংগ্রহ করেন স্যার জর্জ কেইলি, চানিউট, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং ল্যাংলির এরোনেটিক সংক্রান্ত গবেষণার তথ্যাদি। ১৮৯৬ এবং ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বিমান তৈরির ওপরে যত প্রকাশনা রয়েছে সেগুলো তারা সংগ্রহ করে মনোযোগ দিয়ে পড়েন। সেই সময় তাদের মতো অনেকেই উড়োজাহাজ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তারা কেউই সেভাবে সফল হতে পারেননি। তাদের দেখানো পথ ধরেই রাইট ভাতৃদ্বয় শুরু করেন বিরামহীন গবেষণা।
১৮৯৯ সালের জুলাই মাসে উইলবার রাইট পাঁচ ফুট উচ্চতার একটি বাক্স-ঘুড়িতে পাখা বেঁধে উড়ার চেষ্টা করেন। পরের বছরই তারা গস্নাইডার তৈরি করেন। এটিকে উড়ানোর জন্য আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার কিটি হকে নিয়ে আসা হয়। যদিও উড্ডয়নটি মাত্র ১২ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল, এতে তারা মোটেও হতাশ হননি। এরপর তারা ১৯০১ এবং ১৯০২ সালে পরপর দু'টি পরীক্ষা করেন। তৃতীয়বারের পরীক্ষায় নিজেদের উদ্ভাবিত যন্ত্র ব্যবহার করে তারা কিছুটা সাফল্য পান। প্রায় ১ হাজার বার যন্ত্রটি উড়ানো হয়। এর নাম দেন ঋষুবৎ-১. ১৯০৩ সালের ২৩ মার্চ রাইট ভ্রাতৃদ্বয় উড্ডয়নকৃত গস্নাইডারের প্যাটেন্ট লাভের জন্য আবেদন করেন। এরপর তারা তাদের গবেষণা অব্যাহত রেখে ১৯০৪ সালে তৈরি করেন ঋষুবৎ-১১১। এটি তারা ১০৫ বার উড্ডয়ন করেন। উড্ডয়নের এ ঘটনা পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি গণমাধ্যমে বিশেষ করে আমেরিকার বিখ্যাত 'হেরল্ড ট্রিবিউন' পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে, যেখানে দুই ভাইকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য 'রাইট ব্রাদার্স মেমোরিয়াল ট্রফি' প্রদান করা হয়। জানা যায়, উত্তর ক্যারোলিনার কিটি হক, যেখানে রাইট ঋষুবৎ -এর প্রথম ফ্লাইট ছিল।
প্রতি বছর রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের নিজ শহর ডেটন ও ওহহিওতে '১৭ ডিসেম্বর' দিবস উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই দিনে অপরাপর কাজের মধ্যে আছে তাদের সম্মানে মধ্যাহ্ন ভোজ, বিমান চালনার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা এবং বিমান জাদুঘর বা বিমানবন্দরে ফিল্ড ট্রিপ ইত্যাদি। নিজ শহর ডেটন ও ওহহিও ছাড়াও সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা অ্যারোস্পেস একাডেমি, ফ্লোরিডা এয়ার মিউজিয়াম এবং সান এন ফান অ্যারোস্পেস এক্সপোসহ বেশ কয়েকটি স্থানে দিনটি উদযাপন করা হয়।