আজকের যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন মানুষের জীবনপ্রবাহকে আগাগোড়া বদলে দিয়েছে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে এসেছে অত্যন্ত জরুরি ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। নৈসর্গিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ আর মসজিদ-মন্দির-গির্জাতে গিয়ে আগের মতো তেমন একটা মাথা ঠোকে না বা অপদেবতার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ওঝার কাছেও ছোটে না। বিদর্ভ অজ্ঞতা থেকে মানুষকে ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখিয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীদের আলস্যহীন প্রয়াসে মানবজাতি আজ শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন, বিবিধ বিদ্যার জ্ঞানের অনুশীলন ও তদনুযায়ী সুন্দর জীবনযাত্রার শীর্ষে উন্নীত হতে পেরেছে।
প্রাত্যহিক জীবনের চূড়ান্ত উন্নতির এবং অঢেল ধন-সম্পত্তির মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। মানুষজন রোজ ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে অ্যালার্ম ঘড়ির ক্রিং ক্রিং শব্দে বিছানা থেকে উঠেই প্রথম যে টুথব্রাশ ও পেস্ট নেয় সেটাও বিজ্ঞানের দান। রান্নাঘরের সিলিন্ডার গ্যাস, ওভেন, ইলেকট্রিক কেটলি, প্রেসার কুকার, গস্নাস-থালা-বাসন থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য প্রতিটি উপকরণই বিজ্ঞানের আশ্চর্যজনক অবদান। এছাড়া বিনোদনের জিনিস যেমন রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, খবরের কাগজ, টেলিফোন থেকে শুরু করে টেপ রেকর্ডার, ক্যালকুলেটর, এসি, কাগজ-কলম-বই সবই দিয়েছে বিজ্ঞান। বিভিন্ন রকমের অতিমাত্রায় আধুনিক পরিবহণ উদ্ভাবনের ফলে মানবজাতির জীবিকা নির্বাহে এসেছে অতিশয় সুন্দর ও আরামদায়ক গতি। দ্রম্নত বেগে চলে যেমন বাস, কার, মোটরবাইক, সিএনজি, ট্রেন, অ্যারোপেস্নন এসব কিছুই বিজ্ঞানের দান। এছাড়া রিকশা, ইজিবাইক, লঞ্চ, স্টিমার ইত্যাদি তো আছেই। এ সময়ের কর্মব্যস্ত মানুষ বিজ্ঞান ছাড়া এক পাও এগোতে পারে না।
প্রযুক্তি বিজ্ঞানের সহায়তায় সারা বিশ্বে কৃষি খাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে খাদ্য উৎপাদনে মোটামুটি স্বয়ম্ভর ধরা যায়। রোগ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অর্থাৎ চিকিৎসায় এসেছে অভূতপূর্ব সফলতা। আরোগ্য লাভ করা কঠিন এমন রোগের চিকিৎসা করে পুরোপুরি নিরোগ করা হচ্ছে অহরহ নতুন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সহায়তায়। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উদ্ভাবন মানবজাতির প্রতিদিনের জীবিকা নির্বাহে এনেছে আশ্চর্যজনক সাফল্য। আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত মুঠোফোনের মাধ্যমেও প্রয়োজনীয় অনেক কাজ সেরে ফেলা যাচ্ছে মুহূর্তেই। অসহ্য গরমেও এসি চালু করে ঘরে কিংবা অফিসে বসে অনেক দুর্বোধ্য কাজ করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। সারকথা, বিজ্ঞান মানবজাতির জীবনে যেমন আয়েশ এনে দিয়েছে, তেমনি জীবনচলার পথকেও অনেক অবন্ধুর ও গতিশীল করেছে। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উপকারিতার পাশাপাশি অপকারিতাও আছে অনেক। এ সময়ে বিশ্বের সব মানুষই বিজ্ঞাননির্ভর। বিজ্ঞানের তৈরি যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ব্যবহার করার ফলে মানুষ নিজেও অনেকটা যন্ত্রের মতো ভাবাবেগবর্জিত হয়ে পড়েছে। নিজের স্বভাবসিদ্ধতা হারিয়ে ফেলেছে। বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন মানুষের জীবনে যেমন শরীর ও মনের নানারকম ক্লেশ এবং নবাবসুলভ আচার-ব্যবহার ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা এনে দিয়েছে, তেমনি ভোগ্য বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ের চাহিদাও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের কথা, অভাবী মানুষের তো সব চাহিদা নিরসন হওয়ার নয়। তাই অনেকেই ব্যথিত ও সহ্যশক্তিহীন হয়ে পড়েছে। মেকি হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন।
উপসংহারে কথা একটাই, বিজ্ঞানের কারণে মানুষ সুখী নয় কিংবা সহ্যশক্তিহীন হয়ে উঠেছে বাক্যটি পুরোপুরি ঠিক নয়। কেননা, মানুষ অসুখী বা অসহিষ্ণু যাই হয়ে উঠুক না কেন, এটা তাদের বোকামি বা অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয়। এসব সামান্য ক্ষতিকারক দিক বাদ দিলে বিজ্ঞান মানবজাতির পরমবন্ধু। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে মানবসভ্যতা একেবারেই অচল। প্রযুক্তি বিজ্ঞানকে আরও বেশি করে কাজে লাগিয়ে তার সুফল প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তবেই একটি দেশ স্বয়ম্ভর হয়ে উঠবে। বিজ্ঞান বিশেষ জ্ঞান, সত্যনির্ভর জ্ঞান। এই বিশেষ জ্ঞানই ক্ষমতা রাখে, এ জগতের মানুষের মন থেকে যুক্তিহীন ভ্রান্ত সব ধারণা বা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে দূরে সরিয়ে দিতে। আর সেই বোকামির প্রগতিবিরোধী ও গোঁড়ামিপূর্ণ প্রথা যেদিন বাংলাদেশের বুক থেকে সরে যাবে সেদিনই হবে বিশুদ্ধ ও সুন্দর একটি বাংলাদেশ।