আমাদের দেশের ভিত্তি হলো কৃষি। কৃষির উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের উন্নয়নে এবং মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন কৃষক ও কৃষিবিদরা। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাও অর্জিত হয়েছে। দেশে সনাতন কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে তথা বিজ্ঞান-ভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি-বিজ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট বাংলাদেশের প্রথম উচ্চতর কৃষিশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পথচলা শুরু হয়। ধীরে ধীরে কৃষি উন্নয়নের কারিগর তৈরির কারখানা হয়ে ওঠে বাকৃবি। কৃষি গবেষণার আঁতুড়ঘর এই বাকৃবির শিক্ষক ও গবেষকরা নিরলসভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ শুরু করেন। শুরু হয় কৃষির বিপস্নব।
বর্তমানে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে কিন্তু জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এমনতাবস্থায় দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন বাকৃবির জেনেটিক্স অ্যান্ড পস্নান্ট বিস্নডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান খান রবিন। দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চফলনশীল সরিষা ও মিষ্টিআলু নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এবার নতুন করে শুরু করেছেন টমেটোর উচ্চফলনশীল জাত নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম। তার সঙ্গে কাজ করছেন তার স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি শিক্ষার্থীরা। হঠাৎ করেই একদিন অধ্যাপক রবিনের গবেষণা মাঠ পরিদর্শনের সুযোগ পান তানিউল করিম জীম। গবেষণা নিয়ে কথা হয় অধ্যাপক রবিন এবং তার গবেষণায় যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
নৌকা করে ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে গেলাম গবেষণা মাঠে। চোখে পড়ল নেট দিয়ে ঘেরা এক বিঘা জমি। ওই জমিতেই সরিষা, মিষ্টিআলু এবং টমেটো নিয়ে অধ্যাপক রবিনের গবেষণা চলছে। তিনি জানালেন এখানে মূলত মিষ্টিআলু নিয়ে গবেষণা চলছে। দেখলাম ছোট ছোট খন্ড জমি করে অনেকটা জায়গাজুড়ে মিষ্টিআলু লাগানো হয়েছে। তার গবেষণা দলের উদ্ভাবন বড় বড় আকারের বাউ মিষ্টিআলু-৫ তুলে দেখালেন যার এক একটির ওজন প্রায় ২৫০ গ্রামের বেশি। এখনো ১৫ থেকে ২০ দিন পর তোলা হবে আলু। তখন আরও বড় হবে বলে জানান তিনি।
মিষ্টিআলুর গবেষণা নিয়ে অধ্যাপক রবিন জানান, আমরা যে গবেষণাটি করছি সেটির শিরোনাম হলো রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব বায়োফর্টিফাইড সুইট পটেটো ফর বাংলাদেশ অ্যান্ড সাউথ এশিয়া। এ প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টার (সিআইপি)। সিআইপির হেডকোয়ার্টার হচ্ছে পেরুর রাজধানী লিমাতে। সেখান থেকে পাওয়া বীজগুলো আমরা গবেষণাগারে অঙ্কুরিত করেছি। পরে সেগুলো প্রথমে গ্রিনহাউজে জন্মিয়ে করা এবং পরে নেট হাউসে বড় করা হয়। পরে সেগুলোকে আমরা মাঠে নিয়ে এসেছি। ৫৪০টি জেনোটাইপ থেকে আমরা এখানে যাছাই-বাছাই করেছি। পরে বেশ কয়েক রাউন্ড নির্বাচন শেষে এখন ২৩টি জেনোটাইপ নিয়ে কাজ করছি। এখানে আমাদের যে জেনোটাইপগুলো আছে সেগুলোর সবকয়টিই উচ্চ ফলনশীল। একটি গাছে এক কেজির বেশি ফলন হয় এবং সেগুলো স্বল্প সময়ের (৯০ দিন) জাত। তিন মাসের মধ্যে আমরা মিষ্টিআলু তুলতে পারব। এগুলোর কতগুলোর মধ্যে এন্থোসায়ানিন, কতগুলোর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কেরোটিন, কতগুলোতে কম পর্যায়ের কেরোটিন আছে আবার কতগুলো হচ্ছে হোয়াইট ফ্ল্যাশ। তিন থেকে চারটি উচ্চ ফলনশীল বায়োফর্টিফাইড জাত, যেগুলোতে এন্থসায়ানিন অথবা কেরোটিন থাকবে সেগুলো বাছাই করে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার পরিকল্পনা আছে আমাদের। আমাদের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি, আগামী বছর ছাড়করণের জন্য আবেদন
করতে পারব।
মিষ্টি আলু নিয়ে গবেষণারত পিএইচডি শিক্ষার্থী ফাবিহা হক বলেন, আমাদের গবেষণাতে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি স্বল্প সময় এবং উচ্চ ফলনের দিকে। এতে কম সময়ে কৃষকেরা বেশি উৎপাদন করতে পারবেন। পাশাপাশি দ্রম্নত অন্য একটি ফসল চাষ করতেও পারবেন। এতে করে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। মিষ্টিআলু চাষে খরচ কম হওয়ায় কৃষকদের বেশ আগ্রহ রয়েছে। এছাড়া এন্থসায়ানিন ও ক্যারোটিনসমৃদ্ধ জাতকে আমরা গুরুত্ব দেওয়ায় কৃষকের পুষ্টির অভাব পূরণ হবে। এভাবে কৃষকের ভাগ্য বদলে যাবে।
মিষ্টি আলুর পাশেই দেখলাম সরিষা ও টমেটোর খন্ড জমি। এখানে সরিষার খন্ড জমিটি নমুনা হিসেবে রাখা হয়েছে। যেটির প্রধান গবেষণা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে। সেখানেই যাব সরিষার গবেষণা দেখতে। তার আগে টমেটো নিয়ে অধ্যাপক রবিন জানালেন, এখানে টমেটোর দেশি ও বিদেশি জাত নিয়ে গবেষণা করে উচ্চ
ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের কাজ চলছে। এটি এখানো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এরপর গেলাম সরিষার গবেষণা মাঠে। সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহের কাজ করছে মৌমাছিরা। দেখলাম দু'জন শিক্ষার্থী কাজ করছেন মাঠে। তাদের মধ্যে একজন আতকিয়া আবিদা। তিনি জানান, আমি এখানে হাইব্রিডাইজেশন কাজ করছি। এক জেনোটাইপের সঙ্গে অন্য জেনোটাইপের নিয়ে হাইব্রিডাইজেশন করছি। এভাবে কোনো পরিবর্তন হয় কিনা কিংবা নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় কিনা সেটিই আমরা দেখছি।
অধ্যাপক রবিন জানান, বাকৃবির জেনেটিকস অ্যান্ড পস্নান্ট বিস্নডিং বিভাগ থেকে এ পর্যন্ত সরিষার মোট ১০টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলো হলো সম্পদ, সম্বল এবং বাউ সরিষা-১ থেকে ৮ পর্যন্ত। সম্পদ এবং সম্বল উদ্ভাবনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. লুৎফুর রহমান এবং অধ্যাপক ড. আব্দুল কুদ্দুস। বাউ সরিষা-১, ২, ৩ এই তিনটি জাত লবণাক্ততা সহিষ্ণু। তিনটি জাত উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। ওই গবেষণা দলে আমিও ছিলাম। এরপরে অতি সম্প্রতি বাউ সরিষা-৪, ৫, ৬, ৭, ৮ পাঁচটি উচ্চ ফলনশীল জাত আমি রিলিজ করেছি। জাতগুলো ছত্রাকজনিত অলটারনারিয়া বস্নাইট রোগের প্রতি অধিক মাত্রায় সহনশীল। এগুলোর উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকের মাঠে দুই টনের বেশি ফলন পাচ্ছি। যশোর এবং খুলনা অঞ্চলে এই জাতগুলোর দুই থেকে আড়াই টন ফলন পেয়েছি। এর মধ্যে বাউ সরিষা-৫ কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমরা জাতগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা যেমন- কুমিলস্না, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, যশোর, বগুড়া এবং নওগাঁসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছি এবং কৃষকের আগ্রহে পরিণত হয়েছে বাউ সরিষা-৫। জাতগুলোতে ফ্যাটি এসিডসহ সরিষার গুরুত্বপূর্ণ তেলের উপাদানগুলো ভারসাম্য মাত্রায় থাকায় এ জাতের সরিষাগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে আমি মনে করি। বাউ সরিষা-১ থেকে ৮ পর্যন্ত যে জাতগুলো আমরা কৃষকের জন্য রিলিজ করেছি, সেই জাতগুলো ছিল ব্রাসিকা জুসিয়া প্রজাতির। এগুলো ৮৮ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ফসল তো যায় এবং ফলনও ভালো। বর্তমানে আমরা স্বল্প জীবন দৈর্ঘ্যের জাত উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছি যেগুলো হবে ব্রাসিকা ন্যাপোস প্রজাতির। এই জাতগুলোর ৭৮ থেকে ৮২ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যাবে এবং ফলনও উচ্চপর্যায়ের হবে।
মুন মোদক নামে স্নাতকে অধ্যায়নরত একজন শিক্ষার্থী জানান, এখানে সরিষার অনেকগুলো জাত লাগানো হয়েছে। কোন জাতের সরিষায় আগে ফুল এসেছে, কোনটিতে পরে ফুল এসেছে, কোনটিতে ৫০ শতাংশ ফুল এসেছে, কোন জাতের সরিষায় রোগ কম বা বেশি হচ্ছে সেটির পর্যেবক্ষণ এবং নিয়মিতভাবে তথ্য রাখছি আমরা। পরে দেশে বহুল প্রচলিত বারি সরিষা-১৪ এর সঙ্গে তুলনা করব। কারণ আমরা চাই, তার থেকেও উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে।