শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু

সুমন্ত গুপ্ত
  ২১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করতে বঙ্গবন্ধু যান পাবনার বেড়া উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে। ওই অনুষ্ঠানে কয়েকজন নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তাদের নির্যাতিত হওয়ার ভয়ঙ্কর সব ঘটনার কথা বলেন। তাদের কথায় বঙ্গবন্ধুর চোখ ছলছল করে ওঠে। তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন বঙ্গবন্ধু। পরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আজ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে 'বীরাঙ্গনা' খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্যই তারা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই সব স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশ্যে আমি বলছি, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা পিতা হয়েছেন। তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা।' বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিকল্পনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের যেভাবে হেয় প্রতিপন্ন, আশ্রয়হীন, অসম্মান করা হচ্ছিল সে সময় তাদের সামাজিক স্বীকৃতি, গ্রহণযোগ্যতা এবং সামাজিক সম্মান প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের দিয়েছিলেন 'বীরাঙ্গনা' উপাধিটি। করেছিলেন বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। কখনো সহযোদ্ধা হিসেবে কখনো সরাসরি। এ ছাড়া অস্ত্রচালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাশুশ্রূষা, তথ্য সরবরাহ, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, বস্ত্র ও ওষুধপত্র সংগ্রহ করে তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েও যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমাদের নারীরা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও। আর ঠিকানা লেখো ধানমন্ডি ৩২। মুক্তিযুদ্ধে আমার মেয়েরা যা দিয়েছে সেই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?' স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত নারীদের 'বীরাঙ্গনা' খেতাবে ভূষিত করেন।

১৯৭২ জুড়ে দেশে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের গ্রহণে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় বিদেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আইনের। এই সমস্যা সমাধানে তিনি ১৯৭২ সালে ইধহমষধফবংয অনধহফড়হবফ ঈযরষফৎবহ (ঝঢ়বপরধষ চৎড়ারংরড়হং) ঙৎফবৎ, ১৯৭২ (চ.ঙ. ঘড়. ১২৪ ড়ভ ১৯৭২) জারি করা হয়। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিটেশন, মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির মাধ্যমে বহু যুদ্ধশিশুকে বিদেশে দত্তক দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দত্তক হয়নি এমন শিশুদের বিভিন্ন শিশুসদনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। (তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ, নিউইর্য়ক)। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার, সামাজিক সম্মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং তাদের ত্যাগের স্বীকৃতিতে 'নারী পুনর্বাসন বোর্ড' গঠন করেন। নির্যাতিতা নারীদের পুনর্বাসন এবং আবাসনের জন্য এ বোর্ড গঠন হয়। ঢাকার ধানমন্ডিতে যে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ছিল তা পরিচালনা করতেন বেগম মুজিব। তাদের জন্য আশ্রয় ও ভাতার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, নারীদের উৎপাদনমুখী কর্মকান্ডে নিয়োজিত করা, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিকিৎসারব্যবস্থা করা, তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য বৃত্তিপ্রথা চালুসহ নানাবিধ কাজ করেছিলেন। ঢাকার বেইলি রোডে চালু করা হয় সেক্রেটারিয়াল কোর্স, মোহাম্মদপুরে সেলাই ও কারুশিল্প প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, সাভারে খোলা হয় পোল্ট্রি ফার্ম- এভাবে সারা দেশ বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আবাসন সুবিধা সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিকল্পনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়। নারী উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি এ খাতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। শহিদদের স্ত্রী ও কন্যাদের জন্য চাকরি ও ভাতার ব্যবস্থা করা হয়, এ ছাড়া এ পরিকল্পনায় নারীদের অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম আন্তঃখাত উদ্যোগ নেয়া হয়। নারী পুনর্বাসন বোর্ডের দায়িত্ব ও কার্যপরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৪ সালে বোর্ডকে পুনর্গঠিত করে সংসদের একটি অ্যাকটের মাধ্যমে নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<93399 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1