শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়াল সে কালো রাতে

তাশফিয়া আলম
  ২১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সূর্য ডুবল। পাঁচটা বেজে চুয়ালিস্নশ। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট বিমানে করাচি পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন। কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈত্রের হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। তারপর দু'ঘণ্টাও যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাকবোঝাই করে সৈন্য ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশনা। ছক অনুযায়ী তাদের পজিশন। গোলান্দাজ, সাঁজোয়া পদাতিক তিন বাহিনী থেকে বাছাই তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক। রাত ১০টা ৩৫। নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল বর্তমানে শেরাটন হোটেল ঘিরে ফেলেছে। ডিসিপশনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন ইয়াং ক্যাপ্টেন লিখে দিল- বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশি সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। না কারফিউর কোনো ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। কাঁচা ঘুমে জাগানো বারণ। ঢাকা-করাচি টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচারও। কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা। 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে মার্কিন ট্যাঙ্ক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানি হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। প্রতিটি রুমে রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জলস্নাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্ত শকুনিরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; পাকি জান্তারা সেই রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার কাজ করতে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে। তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ টানিয়ে এনে মাটিচাপা দিয়েছিল পাক-সেনারা। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। কাজ শেষে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়।

চারদিক রক্ত আর রক্ত, সারি সারি শহিদের লাশ। সেদিন হিংস্র শ্বাপদ পাক-বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ ছাত্রী লাফ দিয়ে পড়েছিল। নরপশুরা সেদিন হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও-পোড়াও প্রত্যক্ষ করেছিল শহরের সব জায়গায়। সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দপ্তরে পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রম্ন ট্যাঙ্ক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দপ্তর। সে রাতে ১১০০ বাঙালি পুলিশের রক্ত ঝরিয়েও তারা ক্লান্ত হয়নি, গুঁড়িয়ে দেয় পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দেয় সবকিছু।

ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাক-বাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা শহরের বেঁচে যাওয়া মানুষ পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জিঞ্জিরার দিকে যাত্রা করে। জিঞ্জিরা ও এর আশপাশের এলাকাগুলো ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধু্যষিত এলাকা। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক চিহ্নিত ছিল। যখন ঢাকা থেকে পালিয়ে সবাই সেখানে জড় হতে থাকে, তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নেয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<93397 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1