শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার নারী সূর্যসৈনিক

আমাদের প্রতিটি দিন-রাত কেটেছে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। প্রায়ই গোলাবর্ষণ করত পাক-সেনারা। তখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হতো। কখনো মাটির নিচে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হতো। যখন চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারত যাচ্ছিলাম, তখন উভয় দিক থেকেই পাক সেনারা গোলাবর্ষণ করছিল।
তমালিকা মুনমুন
  ২১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

'তখন পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বিভীষিকা চলছে শহরময়। জানালার ফাঁকে চোখ রাখলেই দেখা যায় চতুর্দিকে ছত্রখান মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন, ঝাঁজরা; শহরজুড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, তপ্ত বাতাসের হলকায় দগ্ধ মানুষ আর বারুদের কটু গন্ধ।'

মাহমুদুল হকের উপন্যাস 'আমার বোন', ঢাকা, ১৯৭৬, পৃ. ১৫৫-তে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের এমনই চিত্র। পরাধীনতার গস্নানি মেনে নেবে না বলে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কিন্তু জেগেছিল যুদ্ধের চেতনায়। সে সময় মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজের ব্যাপক আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যদিও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে তার প্রতিফলন ঘটেছে খন্ডিতভাবে। বীরত্বের ভূমিকার চেয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে কোনো কোনো উপন্যাসে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের খন্ডচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নারগিস বলেন, 'আমাদের প্রতিটি দিন-রাত কেটেছে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। প্রায়ই গোলাবর্ষণ করত পাক-সেনারা। তখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হতো। কখনো মাটির নিচে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হতো। যখন চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারত যাচ্ছিলাম, তখন উভয় দিক থেকেই পাক সেনারা গোলাবর্ষণ করছিল।'

\হ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে স্বামী শিক্ষাবিদ এবং আইনজীবী আফজাল খানের সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন নারগিস। ২৫ মার্চ পাক-হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে পরের দিন চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারত রওনা করেন তারা। উভয়পাশে গোলাবর্ষণ চলতে থাকলেও জীবন বাজি রেখে মাত্র ছয় মাসের শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেন।

রাঙামুড়ায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন; কিন্তু কোলের শিশু থাকায় সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি নারগিসের সোনামুড়া, উদয়নগর, পদ্মনগরসহ বিভিন্ন শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা এবং শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে ওষুধ ও ত্রাণ বিতরণ করতেন; এরপর অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠিত হলে পদ্মনগর যুব শিবিরে চলে যান। সেই শিবিরের যাবতীয় সেবামূলক কাজের তদারকি করতেন নারগিস। একবার পদ্মনগর শিবিরে ব্যাপকহারে জ্বর এবং আমাশয়ের প্রকোপ দেখা দেয়। এ সময় তার নিজের শিশুটিও আমাশয়ে ভোগে; তবে স্রষ্টার কৃপায় কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যায় ছোট্ট শিশুটি।

আরেক সংগ্রামী নারী রাজিয়া সরকার। নারীদের কর্মকান্ড যখন ছিল নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে বাঁধা। সেই ১৯৬২ সাল থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও খাবার সরবরাহ এবং মূল ভূখন্ড থেকে তথ্য সরবরাহের কাজ করতেন রাজিয়া।

ঢাকার ঘোড়াশালে জন্ম রাজিয়া সরকারের, পিতা রইসুদ্দিন আহমেদ এবং মাতা জগত বেগম। তরুণ বয়স থেকেই বাম আদর্শে উজ্জীবিত রাজিয়া, ১৯৬০ সালে বৈবাহিক সূত্রে দিনাজপুর চলে আসেন; তবে বিয়ের পরও শুধু ঘর-সংসারের চার সীমানায় আটকে ছিলেন না তিনি। ১৯৬২ সাল থেকে ভাসানী ন্যাপের সঙ্গে কাজ করেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ঘিরে আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে ছিলেন; এ ছাড়া পূর্ববাংলা স্বাধীন করার জন্য মওলানা ভাসানীর ডাক 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো' এই স্স্নোগানে সাড়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন রাজিয়া।

স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কালিয়াগঞ্জ অঞ্চলে জুন মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন তিনি। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন এই সাহসী নারী। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংরক্ষণ ও খাবার সরবরাহ করতেন, তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রেখে রাতের আঁধারে ভারতে পাঠাতেন প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য রাজিয়ার এসব কর্মকান্ডের কথা জানার পর কেরোসিন ঢেলে তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাক সেনা ও তাদের দোসররা। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে নিজের সাজানো-গোছানো সংসারের কিছুই পাননি রাজিয়া? এমনকি বাড়ির দরজা, জানালাও অবশিষ্ট ছিল না; ছিল শুধু ছাদ আর মেঝে।

কালিয়াগঞ্জে কর্মরত অবস্থায় রণকৌশল হিসেবে রাজিয়া এবং তার কলেজ শিক্ষক স্বামী যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও গাইবান্ধায় পাড়ি জমান সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলেজে শিক্ষকতা চালিয়ে যেতে থাকেন। রাজিয়ার স্বামী এর পেছনে একমাত্র লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু শহরে প্রবেশ করতে পারত না, তাই শিক্ষকের ভূমিকায় শহরে বাস করে পাক-সেনাদের গতিবিধি এবং যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করা, একদিকে গোয়েন্দাগিরি এবং অন্যদিকে সংবাদকর্মীর দায়িত্ব পালন করতেন রাজিয়া এবং তার স্বামী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাওয়ার সময় পাক-সেনাদের গুলির মুখে পড়েন নারায়ণগঞ্জের আরেক বীর সাহসী নারী ফরিদা আখতার। সেই ঘটনার কারণে হারাতে হয় পাঁচ মাসের শিশু পুত্রকে।? তবুও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন সকল ত্যাগ শিকার করে? মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন- 'মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় আমার এক ছেলেকে হারিয়েছি, পাক-সেনারা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। সেই গুলি আমার মাত্র পাঁচ মাসের শিশুপুত্রের গা ছুঁয়ে গিয়েছিল। তবে গুলিটা তার গায়ে লাগেনি? কিন্তু পাক-সেনাদের গুলি থেকে বাঁচতে আমি যখন দৌড় দিয়েছি তখন ছেলেটা আমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। সে ইরি খেতের মধ্যে পড়েছিল। পরে তাকে উদ্ধার করে রেডক্রসের হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি কিন্তু তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।' এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট এবং ত্যাগের কথা জানালেন এই মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<93396 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1