শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রেরণার বাতিঘর

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া বেগম মুজিবের গায়ের রং ফুলের মতো ছিল বলে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। ফুলের মতোই কোমল তার হৃদয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের দুর্দিনে তাকে হতে হয়েছে পাহাড়ের মতো অটল। স্বামীর সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে ছায়াসঙ্গীর মতো জুগিয়েছেন সাহস ও উদ্দীপনা।
মনিরা মিতা
  ১৪ মার্চ ২০২০, ০০:০০

আমি সেই মানুষটির কথা বলছি, যার নাম নিলেই শ্রদ্ধায় অবনমিত হয় প্রতিটি বাঙালির হৃদয়। আমাদের পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ তিনি। তিনি শত বছরের শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়নের হাত থেকে বাঙালিকে মুক্ত করেছিলেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যিনি কাজ করে গেছেন বাঙালির জন্য, তিনিই আমাদের বঙ্গবন্ধু। তিনি শুধু বাঙালির নেতা নন, বিশ্বের মহান নেতা ছিলেন। দেশ ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে তার অসামান্য অবদানের জন্য যে নারীর ত্যাগ, অবদান ও প্রেরণার কাছে ঋণী ছিলেন- তিনি হলেন তারই স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যেখানে নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল, সেখানে পড়ালেখা তো কল্পনাই করা যেত না। তবুও তিনি দমে যাননি। সেই সময়ে ঘরে বসেই পড়ালেখা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের বিদ্যা ছাড়াই তিনি ছিলেন প্রতিভাসম্পন্ন, জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল।

বায়ান্ন থেকে একাত্তর অবধি সংগ্রামে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছায়ার মতো ছিলেন। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বেগম মুজিব ছিলেন তার প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শেখ মুজিবের সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে তিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন। এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া বেগম মুজিবের গায়ের রং ফুলের মতো ছিল বলে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। ফুলের মতোই কোমল তার হৃদয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের দুর্দিনে তাকে হতে হয়েছে পাহাড়ের মতো অটল। স্বামীর সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে ছায়াসঙ্গীর মতো জুগিয়েছেন সাহস ও উদ্দীপনা।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রায় দেড় বছর তাকে আটক করে রাখল। যেহেতু স্বামী কারাবন্দি, সে জন্য তাকে কেউ বাড়িভাড়া দিতে চাইল না। তিনদিনের নোটিশে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার মনের জোর ছিল প্রবল। দুঃসময়েও সব দিক লক্ষ্য রেখে শান্ত মনে নিজেই সামলাতে পারতেন সবকিছু। ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু কষ্ট আর অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি সংসার চালিয়ে যেতে সমর্থ হন। নিজেই সন্তানদের কাপড় সেলাই করতেন। তাদের লেখাপড়ার দিকে লক্ষ্য রাখতেন। পিতার অভাবটা নিজের স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতেন। আবার তাকে মামলার খোঁজখবর নিতে আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। কারাবন্দি স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে হয়েছে। স্ত্রীর এই ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু একটি ঘটনা প্রসঙ্গে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।' (পৃষ্ঠা-১২৬)

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলেই বত্রিশ নম্বর বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কখনো থাকতে রাজি হননি। বাড়িতে কার্পেট, দামি আসবাবপত্র, এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করেননি। নিজের হাতে স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতেন অথবা কখনো নিজে নিয়ে যেতেন। একজন আদর্শ নারীর প্রতীক যেন তিনি। তার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই একজন মমতাময়ী মায়ের প্রতিকৃতি।

মহীয়সী এই নারীর কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের যে কালরাতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে, সে সময়েও অর্থাৎ জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব ছিলেন ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হিসেবে।

ঘরে বন্দি নারী আজ মাটি থেকে আকাশ, উত্তর থেকে দক্ষিণ, মহাকাশ থেকে গ্রহ নক্ষত্র নিজেদের দক্ষতার পদচিহ্ন রেখে চলছে। ঘরে-বাইরে শত সহস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিশ্বময় আলোর জ্যোতিকে আলোকিত করছে। বঙ্গবন্ধু ও ফজিলতুন্নেছা মুজিব নারীদের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। নারীসমাজ তাদের জীবনী থেকে প্রেরণা নিয়ে আরও উদ্যমী হয়ে উঠবে। নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার মনোভাব তৈরি হবে। ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা নারীরাও ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<92428 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1