বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। এ দেশের নানা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাসও অন্তত নতুন নয়। গত শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই নারীশিক্ষার আন্দোলনের পথিকৃত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথা যেমন আমরা জানি, তেমনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সশস্ত্র সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের উদাহরণও আমাদের আছে। পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই ভাষার জন্য লড়াইয়ে লিলি খান বা তেভাগা বিদ্রোহের ইলা মিত্র বা হাজারো সাওতাল চাষি বা ফুলবাড়ীর আন্দোলনকারীদের মতো পূর্ব-নারীদের নাম আমাদের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের স্বাধিকার আর মহান স্বাধীনতার লড়াইয়েও বাংলার নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না। স্বাধীনতাপরবর্তী দেশে বরং তাদের উপস্থিতি অনেক বছর পর্যন্ত নামান্তর। তবে ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশে দেখা দেয় সত্যিকার অর্থে নারী আন্দোলনের নানা উপদান ও উপকরণ। শ্রমবাজারে নারীর বাঁধভাঙা অংশগ্রহণ সত্ত্বেও পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে আটক সাধারণ ও প্রান্তিক নারীরা এখনো বাল্যবিয়ের শিকার হন। যে নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, তার কর্মক্ষেত্রে মকসুদ যা-ই হোক না কেন, ঘরের কাজ তার পেছন ছাড়ে না কখনোই! তবে আমাদের প্রচলিত বয়ানের মধ্যে নারী হিজাব পরলে কেমন 'জঙ্গি' বা ওড়না না পরলে কেমন 'খারাপ মেয়ে'- এসব পুংব্যাখ্যা এমনকি কর্মঠ, উদ্যমী, নিজের পায়ে দাঁড়ানো নারীর কর্তাসত্তাকেও নাকচ করে টিকে থেকেছে। এ রকম পটভূমিতে দাঁড়িয়ে যখন দেখি, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারীরা সরকারি চাকরিতে নারী কোটা বাতিল চান, তখন প্রমাদ গুনেছিলাম। কারণ, পাঠকরাও মানবেন, যে নারীর ব্রাত্য হয়ে থাকার অনেক জায়গা এখনো রয়ে গেছে, যার কারণে বড় পদে তাদের প্রবেশ এখনো বাধাহীন নয়। কাজেই ইতিবাচকভাবে তাদের উপস্থিতিকে উৎসাহিত করার দরকার যেমন আছে, তেমন রয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, দ্বিভাজিত লিঙ্গপরিচয়ের বাইরের মানুষ, যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন জাতিগত পরিচয়ের মানুষের উপস্থিতির প্রয়োজন। এর মধ্যে আসে জুলাই অভু্যত্থান। এ অভু্যত্থান '৩৬ জুলাই' (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্যে দিয়ে একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থী-জনতার অভু্যত্থানে পরিণত এ বর্ষা-জাগরণকালে নারী, ভিন্নধর্ম ও জাতিসত্তা এবং প্রান্তিক বা নন-বাইনারি লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষসহ সব ধরনের জনগণকে যেমন জোরালো ভূমিকায় দেখা গেছে, তেমনি '৩৬ জুলাই'-এরপর সেই ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের অবদানকে খুব বেশি উদ্?যাপন করতে আমরা দেখিনি। উল্টো আমরা দেখেছি, ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, জাতিগত বা ধর্মের বিভিন্ন ফেরকার তফাতকে সামনে এনে তাদের বিরুদ্ধে এক রকমের সংঘবদ্ধ সহিংসতা চলেছে দেশজুড়ে। বিশেষত নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য দেশ অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। শিল্পস্থাপনা, ভাস্কর্য, শিল্পকলা ভাঙা হয়েছে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, মাজার ভাঙা হয়েছে, হিন্দুদের ওপর হামলা ও দুর্গাপূজার আগে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে, পাহাড়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের ওপর হামলা ও হত্যাকান্ড ঘটেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপরে নানারকম বিচারবহির্ভূত শাস্তির নামে প্রতিশোধ নেওয়া ও হিংস্রতা চলেছে। এসবের কোনো ঘটনায় প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন ও প্রচারণার আশঙ্কা যদি সত্যও হয়, তবু একটি ঘটনা ঘটলেও তা নিন্দাযোগ্য এবং সরকারের দুর্বলতাকে নির্দেশ করে। এর মধ্যে ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলে নারীর ওপর, তার চলাচল ও পোশাকের স্বাধীনতার ওপর অন্যায় আক্রমণের প্রতিটি ঘটনা নারীসহ প্রান্তিক লিঙ্গপরিচয়ের মানুষকে অনেক বেশি ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলেছে। আইনের শাসনের অভাব সে ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। ফলে, নানা তরিকার মানুষের নানা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ আদায়ের কেন্দ্র হয়ে ওঠার বিশৃঙ্খলা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য বিপজ্জনক, তবে তা নারী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য বেশি বিপজ্জনক। আর যেন কোনো প্রান্তিক মানুষ ক্ষতির শিকার না হয়, তার জন্য কাজ করা 'নারী অধিকারের রাজনীতি'র প্রধান কর্তব্য। নারীর নিজের শরীর, জীবন-জীবিকা নির্বাচনে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাধা অপসারণ করতে হবে। শিশুবয়স থেকে সমতার ধারণা পারিবারিক ও বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শেখাতে হবে, বাল্যবিয়ে বন্ধ করে মেয়েশিশুদের শিক্ষা থেকে ঝরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। যদি শুধু নারীদের অবস্থার দিকেও তাকাই, তবে আন্দোলনের পর আমরা নারীদের একটা অধস্তন জায়গায় দেখলাম; যেন বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে তাদের কথা বা অবদান উলিস্নখিত হয়। উদ্?যাপনে তারা নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা নেই; তারা কেবল যেন রাতের বেলা হলের তালা ভেঙে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে বা লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, বুলেট উপেক্ষা করে রাস্তায় আন্দোলনে-মিছিলের সামনে থেকে, পুলিশের হাত থেকে আন্দোলনকারীদের উদ্ধার করে বা ডিবি অফিসে আটক থেকে আন্দোলন চাঙা রেখে আবার ফিরে গিয়েছেন আড়ালে। রাস্তায় প্রাণ দেওয়া শ্রমিক শ্রেণির মানুষের পরিবারের কথা বা আহত মানুষের আহাজারিও যেন আমাদের নানা নেতৃত্বের উদ্?যাপনে হারিয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম, আহত-নিহত মানুষের তালিকা তৈরি বা তাদের জন্য হাসপাতালের সহায়তা দিতে অন্য আরেক দল মানুষ নিরলস স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন, যাদের মধ্যে নারীদের অংশ কম নয়। অথচ আমরা তাদের স্বর শুনিনি বা নারী সমন্বয়কদের তেমন দেখতেও পাইনি। মনে করে, জোর করে করে তাঁদের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়, সাংবাদিকের ধরা ফ্রেমেও নারী সমন্বয়কদের উপস্থিতি কম দেখা যায়। এর মধ্যে নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধীদের আহ্বায়ক কমিটির মুখপাত্র হিসেবে দুজন নারীর থাকা আশা জাগালেও নিন্দুকরা একে টোকেনিজম বা আলংকারিক উপস্থিতি বলে সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে ফেমিনিস্ট অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ক্ষুব্ধ নারী সমাজসহ আরও নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ও নাগরিকরা নারীদের জন্য বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে নানা দাবি, কর্মপরিকল্পনা ও প্রস্তাব করেছেন- যার সিংহভাগই পূরণ হয়নি বা তাদের শঙ্কা সত্যি হয়েছে নারীরা আরও প্রান্তিক হয়েছেন। কিন্তু পরিত্রাণের উপায় কী? প্রথমত, নারী ও প্রান্তিকজনের স্বরকে হাওয়া করে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে সারাক্ষণ উচ্চকিত থাকা- যারা সব আলোচনা বা বয়ান তৈরি করতে কেবল বাঙালি মুসলমান পুরুষ ছাড়া আর কাউকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা মননে স্থান দিতে পারেন না, তাদের নিয়মিত প্রতিরোধ করতে হবে। নারী ও প্রান্তিক মানুষের সাফল্য, অর্জন ও অংশগ্রহণকে উদ্?যাপন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে, মনোনয়নে ও প্রতিনিধিত্বে নারী ও প্রান্তিকের উপস্থিতি বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। সদস্যদের মধ্যে নারী ও সংখ্যালঘু বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, সব লিঙ্গপরিচয়ের মানুষের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, শিক্ষালয়, রাস্তা ও জনপরিসর তৈরি করায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যে কোনো নিপীড়ন বিশেষত যৌন নিপীড়ন মোকাবিলায় আইন প্রণয়ন করতে হবে, ইতোমধ্যে হওয়া মামলার দ্রম্নত শুনানি ও বিচার করতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করে স্বাধীন কমিশন গঠন করে সাইবার জগতে নারীকে সুরক্ষা দিতে হবে।