যে কোনো সমাজ বা জাতির গঠন ও উন্নয়নের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীর যে বিরাট ভূমিকা রয়েছে তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসেও নারীর অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কোনো অংশেই কম ছিল না নারীর অবদান। এই গণ-অভু্যত্থানে পুরুষের পাশাপাশি সমন্বয়কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন নারী শিক্ষার্থীরা এবং আন্দোলনের মাঠপর্যায়ে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সর্বস্তরের হাজার হাজার নারীর অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ সংবিধানে সব নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হলেও এখনো কর্মক্ষেত্র, পরিবার, সমাজসহ সব জায়গায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যেন তারা এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক!
ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগের পর নতুন করে আবার জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। এই নবজাগরণের পর সবারই প্রথম চিন্তা দেশের 'সংস্কার'। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশ নিয়ে প্রত্যাশারও কমতি নেই। নতুন বাংলাদেশে নারীরা চায় বৈষম্যহীন সমাজ। একজন নারীর সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক। প্রত্যেক নারীর স্বপ্ন এমন একটি সমাজের যেখানে নারীরা তাদের সক্ষমতা ও প্রতিভা বিকশিত করতে পারবে, নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারবে এবং সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন নারী-পুরুষ সর্বক্ষেত্রে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকবে। তাই নারীদের এই অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নতুন দেশ নিয়ে তাদের স্বপ্ন আগে নিশ্চিত করা জরুরি।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় একান্ন শতাংশ নারী হলেও, নিরাপত্তাহীনতা যেন নারীর জীবনে একটি অভিশাপ। কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ এমনকি পরিবার সবখানেই নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে চারজন নারী ধর্ষণের শিকার হয় বলে জানা যায়। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা হয়ত আরো বেশি। ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠিন আইন থাকলেও এর প্রয়োগ খুবই কম। পরিবার, কর্মস্থল এমনকি গণপরিবহণেও দিন দিন ইভটিজিং বেড়েই চলেছে। তাই নারীর জন্য বিশেষ গণপরিবহণ এখন সময়ের দাবি। এখনো বিভিন্ন রোগে নারীদের মৃতু্য হয় অনেকটা অসহায়ভাবে। জরায়ু ক্যানসারেই প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার নারীর মৃতু্য হয়। তাই নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কর্মস্থলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বৈষম্য। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ পদ না দেওয়া, কম বেতন, মতামতের গুরুত্ব না দেওয়া- এসব অসমতা দূর করতে হবে। সমাজের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারেও নারী বৈষম্যের শিকার। সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রেও তার প্রাপ্য অংশটুকু দেওয়া হয় না। দেশের মোট নারীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই দরিদ্র এবং শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এদের স্বল্পমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব।
এই প্রসঙ্গে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে 'শিকল ভাঙার পদযাত্রা' কর্মসূচিটি প্রণিধানযোগ্য। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে তের দফা দাবি নিয়ে কাজ করছে এই কর্মসূচিটি। দাবির মধ্যে রয়েছে, সারাদেশে ধর্ষণ, যৌন সহিংসতায় যুক্তদের দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক ও ন্যায্য শাস্তি নিশ্চিত করা; শিল্পপতি ও ধনকুবেরদের নারী নিপীড়নমূলক অপরাধ বিচারের আওতায় এনে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করা এবং অন্যায্যভাবে খারিজ হয়ে যাওয়া মামলা পুনঃতদন্ত করা। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন পুনঃসংস্কার করার মাধ্যমে আইনের নানা দিকসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই 'ভিক্টিম বেস্নমিং' (অর্থাৎ দোষারোপ করা/নিন্দা জানানো) বন্ধ করা; আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে মিল রেখে আইনি ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন করা। মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করা। এছাড়াও শিশু ও নারীদের ওপর সব ধরনের যৌন এবং সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করা; হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর করা এবং সিডো সনদে বাংলাদেশের স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি গ্রামীণ সালিশ ব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা; প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ-ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি, প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে অবহিত করা) যোগ করা। সেইসঙ্গে, কোনো শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে নব্বই দিনের মধ্যে দ্রম্নততম ট্রাইবু্যনালে অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা; নারী নিপীড়নের শিকার হলে অভিযোগ জানাতে গেলে থানা ও আদালতে পুলিশি ও অন্যান্য হয়রানি বন্ধ করা; গণপরিবহণে নারীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা; নারী অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
নতুনভাবে দেশকে ফিরে পাওয়ায় নারীদের প্রত্যাশার অন্ত নেই। নারী হিসেবে যে কারো স্বপ্ন এমন একটি সমাজের যেখানে সে প্রতিভাসক্ষমতা বিকশিত করতে পারবে। যেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বৈষম্যের শিকার না হয়ে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং নারীদের অধিকার সুরক্ষিত হবে, এটাই নারীদের প্রত্যাশা। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সব ধর্ষণের বিচার করার মাধ্যমে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে প্রমাণ করতে হবে তারা জনবান্ধব ও নারীবান্ধব সরকার।
তা না হলে এই সরকারের ওপর আস্থার পারদটি দ্রম্নতই নেমে যাবে। আর তাই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, নারীর অধিকার এবং সম্মান রক্ষাসহ যাবতীয় বিষয়াদির ওপর গুরুত্বারোপ করা।