নারীকে মানুষই যদি না মনে করলেন, তাহলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন কার জন্য! নারী তো নারীই, মানুষ কিনা তাই আজ প্রশ্ন! কোথাও নারীকে একেবারেই বাদ দেয়া হয়েছে, আবার কোথাও নারীকে পুরুষের অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। তাইতো পুরুষের গড়া এই সমাজে নারী নির্যাতন চলছে তো চলছেই।
নারী, কখনো সে মা, কখনো সে বোন, কখনো সে স্ত্রী, আবার কখনো সে কন্যা। প্রতিটি পুরুষের কাছেই হাতেগোনা এই কয়েকটি রূপ আছে তাদের। হয় সে মা, বোন, মেয়ে কিংবা স্ত্রী, আর নয়তো সে পরনারী। আর পরনারী মানেই নষ্টা, ভ্রষ্টা, অপয়া, দেহ সর্বস্ব একটি সাকার অস্তিত্ব। কিন্তু সে যেন কোনোভাবেই একজন নারী নয়। বলছি, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীর পরিস্থিতির কথা।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন পুরুষ বাঁচে তার নিজ পরিচয় নিয়ে। কাজ কিংবা বংশ বিভেদে তাদের পরিচয় বদলায়, বদলায় পদবি। কিন্তু এরপরেও তারা পুরুষ। এদিকে এখানে অধিকাংশ নারীরই তার নিজের কোনো পরিচয় নেই। তার পরিচয়, তিনি অমুক সাহেবের মেয়ে, স্ত্রী, মা কিংবা বোন। কিংবা তিনি ওই বাড়ির মেয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটা একটা নিয়মিত বিষয় হয়ে গেছে। তাই এতে কারো তেমন কিছু হয়তো আসে-যায় না। তবে এই অস্তিত্বহীনতাই এক সময় ভয়ংকর রূপ নেয়।
আবারও বলি, নারী মানেই মা, বোন, মেয়ে কিংবা স্ত্রী। আর এরই মধ্যে যদি তিনি কিছুই না হয়ে থাকেন, তবে তিনি পরনারী। মানে দেহ-সর্বস্ব একটি সাকার অস্তিত্ব। একজন পুরুষের মতো কোনোভাবেই তিনি একজন নারী নন। নারী যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের পরিচয়ে একজন স্বাবলম্বী হতেই পারেন না। চারিত্রিক স্খলন রোধে নারীকে তাই এই রূপেই হাজির হতে হবে পৃথিবীর মানুষের কাছে। পুরুষ নারীকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসে না, ভালোবাসে মাকে, ভালোবাসে বোনকে, কন্যাকে; আর বিশেষ পরিস্থিতিতে স্ত্রীরূপের তাকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে। তাই একজন নারীকে আমরা শুধু নারী হিসেবে দেখতেই পারি না। পারি না তার প্রাপ্য সম্মান দিতেও।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটা কথা বেশ প্রচলিত রয়েছে, 'নারী মায়ের জাত'। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নারী কি শুধুই মায়ের জাত? বেঁচে থাকার প্রয়োজনে একজন নারীকে বিভিন্ন সম্পর্কের নারী হয়ে বাঁচতে হয়, সেটা পুরুষকেও হতে হয়, এর মানে কিন্তু আলাদা করে সে কোনো জাত নয়। সে কেবলি একজন নারী, একজন মানুষ। নিজের ইচ্ছের, পছন্দের, ভালোবাসার, সিদ্ধান্তের জাত।
কিন্তু কেন যেন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা নিপীড়িত। পুরুষের একচ্ছত্র সিদ্ধান্তকে নারীর মাথানত করে গ্রহণ করতে হয় এখনো। নারীর যদি কিছু থেকে থাকে, তো শুধু একটি রক্ত-মাংসের দেহ। কিন্তু এই দেহকেও তার অন্যের মর্জিমাফিক চালাতে হয়। নিজের শরীরের প্রতি নারীর নিজের কোনো অধিকার নেই। বিয়ে যতদিন না হচ্ছে ততদিন এই শরীর বাবা-মায়ের, বিয়ে হলে স্বামীর। চুল কতখানি লম্বা রাখতে হবে, জামাকাপড় কেমন পরবে, কীভাবে পরবে সব সিদ্ধান্তই এই প্রভুদের। আর নারী জীবনের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য বিয়ে করে স্বামী-সংসার ও সন্তান জন্ম দেয়া। তারপর দিনের পর দিন ইচ্ছেতে বা অনিচ্ছেতে শয্যাসঙ্গী হয়ে আরেকজনের ঘরে, আরেকজনের হয়ে বেঁচে থাকা। এর অন্যথা কোনোভাবেই করা চলবে না, এটা যুগে যুগে পুরুষতন্ত্রের নির্দেশ। এ নির্দেশ অমান্য করলে চলবে না। এ নিয়মেই এত কাল সমাজ চলেছে। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা নিয়মনীতিকে মূর্খ ছাড়া আর কেই বা অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করে!
উন্নত দেশেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তার বিচার হচ্ছে সেখানে। শাস্তি পাচ্ছে ধর্ষণকারী। ধর্ষণের শিকার নারী সেখানে চিৎকার করে বলতে পারছে না তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সেই দেশগুলোর আইন, সাক্ষী, সমাজ সবাই জোরেশোরে বলতে পারছে ধর্ষণ বা যে কোনো নারী নির্যাতনের কথা। বিচার হচ্ছে, শাস্তি নিশ্চিত হচ্ছে- আর তাই পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। ধর্ষিতা নারী সেখানে আলাদাভাবে পরিচিত হচ্ছে না অথবা সমাজে উপেক্ষিত হচ্ছে না।
ছুরি হাতে এক দুর্বৃত্ত কাউকে আঘাত করলে যেমন আঘাতপ্রাপ্ত লোকটি তার আঘাতের বিষয় অকপটে বর্ণনা করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে, তেমনি উন্নত দেশে ধর্ষণের শিকার নারীও অকপটে তার ধর্ষণের বর্ণনা সবার সামনে প্রকাশ করতে পারছে। ছুরির আঘাত আর ধর্ষণের আঘাতের সঙ্গে অপরাধ মাত্রার তারতম্য থাকলেও উন্নত বিশ্বে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখা হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের সমাজে ধর্ষণকে দেখা হয় ধর্ষণকারীর অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষিতার স্খলন কিংবা অপরাধ হিসেবেও। ধর্ষণের শিকার নারীর বর্ণনা তাকে হেয় করে সমাজে। ধর্ষণকারীর সম্মানহানির পরিবর্তে বরং উল্টোভাবে ধর্ষণের শিকার নারীর সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হওয়ার হুমকির মধ্যে থাকে। নারীর জন্য বাড়তি কোনো কিছু চাই না। নারীর জন্য কোনো বিশেষ অধিকার প্রয়োজন নেই। নারীকে শুধু দেখতে চাই মানুষ হিসেবে। পুরুষ যদি মানুষ হয়ে থাকে, তবে নারীও নিশ্চয়ই মানুষ- শুধু এই স্বীকৃতি চাই। নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে সমাজে থাকবে- শুধু এই নিশ্চয়তা দেবে রাষ্ট্র। আর তা দিতে হলে পুরুষ এবং নারীর মধ্যে যেসব আইনগত পার্থক্য আছে তা দূর করতে হবে রাষ্ট্রকে। যেসব ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার নেই, সেসব জায়গায় আইন পরিবর্তন করে পুরুষ-নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। আর এতে নারীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সরকারকে অধিকার নিশ্চিতে সহায়তা করতে হবে। তবেই নারী এ সমাজে মানুষ বলে গন্য হবে। এ সমাজে কেউ কাউকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয় না- নিজের উদ্যোগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়।