নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা

কেন ধর্ষণ, কেন শিশু ধর্ষণের এমন ভয়াবহ সংখ্যা, ভয়াবহ মাত্রা ও নৃশংস-পাশবিক পদ্ধতিতে সংঘটিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতির মূল কারণগুলো চিহ্নিত করার জন্য গবেষণা ও বিশ্লেষণ একান্ত জরুরি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিমালা গ্রহণ ও সহিংসতা বন্ধে আশু কার্যকর বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সময় অনুরোধ জানিয়ে আসছে। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

দীপ্তি সিকদার
আজকের অগ্রসরমাণ বাংলাদেশের নারীরা সব ধরনের পেশায় দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী তার দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের চলমান অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেই সঙ্গে নারী তার পরিবারের সচ্ছলতা আনতে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ইটভাঙা শ্রমিক থেকে শুরু করে হিমালয়ে চূড়া জয় করা, পোশাকশিল্পে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে থেকে কাজে অংশগ্রহণ, পুলিশ, বিজিবি, সামরিক বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। আমরা লক্ষ্য করছি, শুধু নারী হওয়ার কারণে তাকে প্রতিনিয়ত নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নারী অগ্রসর হচ্ছে, কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে অধস্তন করে রাখছে। এর ফলে, নতুন নতুন ধরনের নৃশংস ও নিষ্ঠুর সহিংসতার শিকার হচ্ছে নারী। নারীরা পরিবার, রাস্তাঘাট, গণপরিবহণ, কর্মক্ষেত্র, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্রই যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে।ইয়াসমিনের ঘটনাটি যদি আবার ফিরে দেখি, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা জানা একটি কিশোরী মেয়ে ইয়াসমিন। সে টাকা জমিয়ে আবার লেখাপড়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ১৯৯২ সালে দিনাজপুরের একটি গ্রাম থেকে ঢাকায় একটি বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজে আসে। ১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট মা'কে দেখার জন্য ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন এবং ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাসনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে। সে বাসটি ভোরের দিকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় চায়ের স্টলে বাসের সুপারভাইজার নামিয়ে দিয়ে চায়ের দোকানদারকে ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী একটি বাসে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌঁছে টহল পুলিশের পিকআপ ভ্যান। পুলিশ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ, পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল ও আব্দুস সাত্তার চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে থাকা ইয়াসমিনকে দিনাজপুর শহরে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে জোর করে পুলিশভ্যানে তুলে নেয়। এরপর তারা দশমাইলসংলগ্ন সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে গণধর্ষণের পর নিমর্মভাবে হত্যা করে তার মৃতদেহ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। দিনাজপুর কোতোয়ালি পুলিশ 'একজন অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার' মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করে এবং লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্তানে দাফন করে। পুলিশ ও প্রশাসনের রহস্যময় আচরণ জনমনে কৌতূহল ও ক্ষোভ জাগিয়ে তোলে। এ সময় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দিনাজপুর জেলা শাখার নেতারা, বিভিন্ন মানবাধিকার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বস্তরের জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। ইয়াসমিন হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধ এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটি, বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠে এক দুর্বার আন্দোলন। ইয়াসমিন হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এ সময় সাতজন নিহত, তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়। এর ফলে, তৎকালীন সরকার ইয়াসমিন হত্যা মামলা ও বিচার প্রক্রিয়ায় দ্রম্নত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং বিচারপ্রক্রিয়া শেষে মাননীয় আদালতের রায় কার্যকর করা হয়। আজ ২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যার প্রায় আড়াই যুগ পরেও কি নারী ও কন্যার প্রতি যৌন সহিংসতা কমেছে? বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সময়ে মোট তিন হাজার ৪৯৫ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৭২ জন কন্যা এবং ৩১৫ জন নারী। তার মধ্যে ১২১ জন কন্যাসহ ২২৬ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ২৩ জন কন্যাসহ ৩৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, সাতজন কন্যাসহ আটজন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ৯৪ জন কন্যাসহ ১৪০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৬৩ জন, এর মধ্যে ১২২ জন কন্যা। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ১২৫ জন, এর মধ্যে ১০৪ জন কন্যা। তার মধ্যে উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ছয়জন কন্যাসহ সাতজন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন মোট এক হাজার ৫২০ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৩৩০ জন নারী ও কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২২৩ জন কন্যা এবং ১০৭ জন নারী। তার মধ্যে ২৮ জন কন্যাসহ ৬০ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ১৬ জন কন্যাসহ ২৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণের কারণে একজন নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এছাড়া, ৩৯ জন কন্যাসহ ৫৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৮২ জনের মধ্যে ৫৪ জন কন্যা। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৫৯ জন। এর মধ্যে ৫৫ জন কন্যা। তার মধ্যে উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আটজন কন্যাসহ ৯ জনের। জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০২১ সালে 'ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, যৌন হয়রানি ও যৌতুক' শীর্ষক সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, কন্যারা ১৮ বছরের কম বয়সি এবং স্কুল পর্যায়ে কন্যারা সবচেয়ে বেশি যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এ ধরনের যৌন সহিংসতার ঘটনায় তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততা বেশি- যা আমাদের সমাজের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নারীর প্রতি সমাজে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কেন ধর্ষণ, কেন শিশু ধর্ষণের এমন ভয়াবহ সংখ্যা, ভয়াবহ মাত্রা ও নৃশংস-পাশবিক পদ্ধতিতে সংঘটিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতির মূল কারণগুলো চিহ্নিত করার জন্য গবেষণা ও বিশ্লেষণ একান্ত জরুরি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিমালা গ্রহণ ও সহিংসতা বন্ধে আশু কার্যকর বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সময় অনুরোধ জানিয়ে আসছে। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ধর্ষণ নারীকে অবদমিত, অধস্তন অবস্থানে রাখার জন্য এবং নারীর মানবিক সত্তা, ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ববোধকে বিনষ্ট করার জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র। সেই সঙ্গে সংবিধানে ঘোষিত নারীর সম-অধিকার, মানবাধিকারের নীতিমালা, বৈশ্বিক মানবাধিকার সনদের নীতিমালার মারাত্মক লঙ্ঘন। বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করছি নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতা তৈরির জন্য কিছুদিনের কোনো প্রশিক্ষণ বা ধারণা দেওয়ার মাধ্যমে নারী-পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি সমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। এর জন্য প্রয়োজন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং নিয়মিত চর্চা নিশ্চিত করা এবং পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। দেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতে লিঙ্গীয় সমতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 'নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।' নারী ও কন্যার প্রতি যৌন সহিংসতা শুধু নারী ও কন্যাকে অবদমিত করে রাখা নয়, পুরো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও অবদমিত করে রাখা এবং মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা। আশায় থাকি, এ দেশে ইয়াসমিনদের মতো আর কোনো নারী ও কন্যাকে কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হতে হবে না। সব প্রচেষ্টা এবং রাষ্ট্রের উদ্যোগে নারী ও কন্যার প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর হবে, বন্ধ হবে সহিংসতা। জয় হোক মানবতার।