৫ অক্টোবর ছিল বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের অবদানকে তুলে ধরে এই দিনটি পালন করা হয়। বাংলাদেশেও এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।
২০২৪ সালের ৫ অক্টোবর শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ১১ জন গুণী শিক্ষকের সম্মাননা প্রদান করা হয় এই দিনে। কিশোরগঞ্জের মফস্বল এলাকার বাঁশগাড়ি-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রায়হানা হক প্রায় পৌনে চার লাখ প্রাথমিক শিক্ষকদের মাঝে দেশসেরা গুণী শিক্ষক নির্বাচিত হন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিক্ষক অসংখ্য পুরস্কার যেমন পেয়েছেন; তেমনি শিক্ষার উন্নয়নে ঘুরেছেন অনেক দেশ। মফস্বলের একটি স্কুলকে তিনি নিজের শ্র্রম এবং দক্ষতা দিয়ে মডেল স্কুলে উন্নীত করেছেন।
রায়হানা হক যে সব পুরস্কার পেয়েছেন তা হলো:
১/ ২০১১ সালে সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন।
২/২০১৭ সালে কিশোরগঞ্জে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন।
৩/২০১৭ সালে সেরা কনটেন্ট নির্মাতা নির্বাচিত হন।
৪/ ২০১৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে কন্টেন্ট প্রতিযোগিতায় সেরা ১৫ নির্বাচিত হন।
৫/২০১৮ সালে আন্তর্জাতিকভাবে ইন্ডিয়ার ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড পান।
৬/২০১৮ সালে মাইক্রোসফট প্রোগ্রাম থেকে লেসন পস্ন্যান উইনার হন।
৭/ ২০২২ সালে মেটা মাইন্ড প্রজেক্ট ঊ ২ অনলাইনে উইনার হন।
৮/বাংলাদেশ থেকে একমাত্র তিনিই স্কাইপ টিচার নির্বাচিত হয়েছেন।
৯/২০২৩ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার জয়িতা নির্বাচিত হন।
১০/ জাইকা থেকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে থাইল্যান্ড, মাইক্রোসফট থেকে সিঙ্গাপুর, স্কুল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে ইন্ডিয়া ও ভিয়েতনামে ট্রেনিং করেছেন।
১১/গ্রামীণফোনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
১২/ ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সার্টিফাই টিচার।
রায়হানা হকের পিতা মো.ফজলুল হক। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভপুর উপজেলার ভাদেরটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন।
মা আনোয়ারা হক। মা-বাবার একমাত্র সুযোগ্য কন্যা রায়হানা হক।
১৯৯৯ সালের ৬ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগদান করেন। পিতার চাকরি সূত্রে সুনামগঞ্জ জেলায় জন্ম রায়হানার। দাদার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার শিবপুর সরকারবাড়ী। ১৯৯৯ থেকে ২০১৪ প্রায় ২৫ বছরের এই পথ চলায় একটু একটু করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে তার শ্রমের, স্বপ্নের আলো। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, ড. ইউনূস যখন নোবেল পান তখন তিনি বিদেশে অবস্থান করছিলেন। হুমায়ূন আহমেদকে যিনি খবরটা প্রথম জানান তিনি আবেগ এবং উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, আমরা নোবেল পেয়েছি।
যখন রায়হানা দেশসেরা গুণী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন তখন প্রাথমিক পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে আমার মনে হয়েছে এ অর্জন আমাদের সবার। এ পুরস্কার প্রাথমিক ও গণশিক্ষার সঙ্গে জড়িত সবার।
\হশৈশবে যখন খেলতে যেতাম তখন প্রায়ই দেখা যেত কারো ছোট ভাইবোন খেলা না পারলেও খেলার জন্য বায়না ধরত। তখন তাদের কান্না থামাবার জন্য 'দুধভাত' নামে খেলায় নেওয়া হতো। এসব দুধভাত খেলোয়াড়রা খেলতো কিন্তু তাদের কোনো গুরুত্ব থাকতো না জয় বা পরাজয়ে।
আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনেই শুধু কম দেওয়া হয় না, তাদেরও দুধভাত খেলোয়াড়দের মতই মনে করা হয়। কোনো পদোন্নতি নেই। নীতিনির্ধারণে শিক্ষকদের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু সেখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। মুখে বলা হয়, 'টিচার ইজ দ্য বেস্ট মেথড' অথচ শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত। যারা কথায় কথায় বিদ্রম্নপের স্বরে, মুখ বাকিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলে, প্রাইমারির 'সামান্য শিক্ষক', তারা একবার রায়হানার যোগ্যতা এবং অর্জনে চোখ বুলিয়ে এবার কথা বলুন। রায়হানা হক প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করলেও অনেকেই ছিলেন তার কাছাকাছি যোগ্যতার। সুতরাং, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে যে ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত তা ভেঙে দিতেই এই পুরস্কার আমাদের হয়ে গেছে। রায়হানার এই আমি থেকে আমরা হয়ে ওঠার পথ মসৃন ছিল না। দীর্ঘ শ্রম এবং স্বপ্নের ফলাফল এই অর্জন।
আগামীতে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে যে কোনো সিদ্ধান্ত, সংস্কার, পরিমার্জনে প্রাথমিক শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অবশ্যই থাকতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন অথবা মেধাহীন মনে করার কোনো কারণ এখন আর নেই।
শ্রেষ্ঠ গুণী শিক্ষক হিসেবে রায়হানার পুরস্কার রাষ্ট্র আর প্রশাসনের কাছে এই বার্তাই দেয় যে, মেধা এবং যোগ্যতায় কোনো দিক দিয়েই পিছিয়ে নেই প্রাথমিকের শিক্ষকরা।
প্রাথমিকের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেবল প্রাথমিকের শিক্ষকদেরই থাকতে হবে। রায়হানার নানা অর্জন সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতারই প্রমাণ।
আগামী দিনগুলো আরও বর্ণাঢ্য হয়ে উঠুক। বদলে যাক রায়হানার হাত ধরে প্রাথমিকের শিক্ষকদের নিয়ে সমাজের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিভঙ্গি।
রায়হানা হক হয়ে উঠুক এ দেশের তরুণদের শিক্ষক ও প্রেরণার আদর্শ।