বর্তমান সমাজে বাল্যবিয়ে একটি জটিল ও গুরুতর সমস্যা। বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধি। বাল্যবিয়ে হচ্ছে: কোনো নাবালক বা নাবালিকার বিয়ে- যা আইনগত বয়সের আগেই হয়ে থাকে। ২০১৪ সালের ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুসারে, বাল্যবিয়ে শীর্ষ দেশ নাইজারের পরেই অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিয়ের হার ৫১ দশমিক ৪০ শতাংশ আর ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিয়ের হার ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার বেশি।
শহরাঞ্চলে তেমন কোনো বাল্যবিয়ে দেখা না গেলেও গ্রামাঞ্চলে এই বাল্যবিয়ে প্রথা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু এই বাল্যবিয়ের পরিণতি হলো মেয়েদের জীবনের বিপর্যয়। বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হলো সামাজিক চাপ। অনেক পরিবারের অভিভাবক মনে করে, অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার ফলে তারা তাদের নিজেদের সম্মান রক্ষা করছে। আবার অনেক অভিভাবক আর্থিক সংকটের কারণেও তারা মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করেন, বিয়ের মাধ্যমে পরিবারের আর্থিক বোঝা কমানো সম্ভব। আবার অনেক অভিভাবক এমনও আছে যারা বিশ্বাস করে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিলে তারা সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু তাদের এই ধারণাগুলো ভুল। এই বাল্যবিয়ের কারণে আজ মেয়েরা বিপদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিয়ে সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যা। কারণ বাল্যবিয়ের কারণে শিশুদের শারীরিক মানসিক ও সামাজিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই বাল্যবিয়ের ফলেই মেয়েরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়; যার ফলে, তাদের শিক্ষার সুযোগ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষার অভাব। এই শিক্ষার অভাবে এবং কর্মসংস্থানের অভাবের কারণেও মেয়েরা আজ আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই বাল্যবিয়ের কারণে মেয়েরা তাদের নিজেদের ওপর থেকে বিশ্বাস হারায়, এমনকি সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখে পড়তে হয়। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাল্যবিয়ের কারণে মেয়েরা মানসিক চাপ এবং হতাশায় ভোগে। এমনকি শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মেয়েরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও হতাশ হয়ে যায়। এই বাল্যবিয়ের কারণে শুধু মানসিক দিক দিয়েই নয় বরং শারীরিক দিক থেকেও মেয়েদের নানান ধরনের বাধার সম্মুখে পড়তে হয়। এই বাল্যবিয়ের কারণে মেয়েরা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করে- যার ফলে, শারীরিক জটিলতা, মাতৃমৃতু্য ও শিশু মৃতু্যর ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাল্যবিয়ের ফলে মেয়েরা শারীরিকভাবে নির্যাতনেরও শিকার হয়। বিশেষ করে যখন তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেয়ে বিয়ে করে। এমনকি অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলেও মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়- যা পরবর্তী সময়ে তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায়। এছাড়াও বাল্যবিয়ে শিশু অধিকার লঙ্ঘনের একটি অন্যতম রূপ- যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। যার ফলে, সামাজিক আইন ভঙ্গের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
এই বাল্যবিয়ের প্রভাব শুধু একটি ব্যক্তি বা পরিবারেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি পুরো সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি প্রতিরোধ করার জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। আমরা বিভিন্নভাবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি যেমন-
১. সচেতনতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের কাছে বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে।
২. বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে, আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
৪. বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।
৫. ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের মতো বিভিন্ন পস্ন্যাটফর্মে সচেতনতামূলক পোস্টের ক্যাম্পেইন চালু করতে হবে।
৬. টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম প্রচার করতে হবে।
৭. স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রচার চালাতে হবে এবং বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে হবে।
৮. স্থানীয় গ্রাম, পাড়া-মহলস্নায় নিয়মিত সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের আয়োজন করতে হবে।
৯. মহিলা ও যুব সংগঠনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
তাই বাল্যবিয়ে রোধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে হবে।