বর্তমান বিশ্বকে বলা যায় প্রযুক্তির বিশ্ব। আর এই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি দেশ। বর্তমানে যে দেশ যতটা প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ সে দেশ তত বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবমান হচ্ছে। আবার এই অগ্রগতিতে নারী ও পুরুষ সমান তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই সে পালের বাতাস লেগেছে আমাদের বাংলাদেশেও। একটা সময় আমাদের দেশের নারীরা পুরুষের ন্যায় সর্বক্ষেত্রে কাজ করবে এমন কিছু চিন্তাই করা যেত না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে আমাদের দেশের নারীরাও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা শুরু করেছে। তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে একজন নারী পরিবার ও কর্মক্ষেত্র একত্রে সামাল দিতে পারেন।
একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে মোট ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন নারী-পুরুষ কর্মরত আছেন। তার মধ্যে নারীর সংখ্যা ৪ লাখ ৯১ হাজার ১৩৯ জন। শতাংশের হিসেবে মোট লোকবলের ২৯ শতাংশ নারী কর্মজীবী- যা আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ইতিবাচক বলা যায়। তবে এখানে যারা কর্মজীবী আছেন তাদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন? এসব চাকরিতে খুব কমসংখ্যক গ্রাম্য নারী সুযোগ পান। এই যে গ্রামীণ নারীরা শহরের নারীদের তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছেন মূলত এই প্রতিপাদ্য নিয়েই বিশ্ব গ্রামীণ নারী
দিবস পালিত হয়।
গ্রামীণ নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা আর তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যেই ১৫ অক্টোবর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস পালিত হয়। যদিও এই গ্রামীণ নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১৯৫৫ সালে। বেইজিং এ অনুষ্ঠিত সম্মেলনেই ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৯৭ সালের পর থেকে জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'উইমেনস ওয়ার্ল্ড সামিট ফাউন্ডেশন' এই দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন দেশকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালন করে। আর ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তারপর থেকেই মূলত আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস নিয়মিত পালিত হচ্ছে।
কেন এই দিবসটি পালন করা হয়? এই দিবসটি মূলত একটি দেশের শহরের নারীদের সঙ্গে গ্রামের নারীদের কী পরিমাণ বৈষম্য বিদ্যমান থাকে তা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়াও গ্রামীণ নারী উন্নয়ন, তাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নানা ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে সেসব বিষয় মনে করিয়ে দেওয়ায় এই দিবসের প্রধান লক্ষ্য। আপনি একজন গ্রামীণ নারীর দিকে তাকালেই এই বৈষম্যের ধরন বুঝতে পারবেন। গ্রামীণ নারীরা সব দিক দিয়ে পিছিয়ে। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নন। যেখানে তাদের খাদ্যেরই অভাব সেখানে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার কথা চিন্তা করা এক ধরনের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এছাড়াও তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা। যে কারণে তাদের মধ্যে শহরের নারীদের তুলনায় অনেক বেশি রোগ বা শারীরিক অসুস্থতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মূলত গ্রামীণ নারীদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া।
একজন গ্রামীণ নারী পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে তাদের বাবা-মায়েরও অনেক দায়ভার রয়েছে। যেমন আমার নানা-নানি দুজনেই আক্ষরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হননি বা হওয়ার সুযোগ পাননি। সেদিক থেকে তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে তারা ছিলেন উদাসীন। যার ফলাফল স্বরূপ আমার মা এতো বেশি জ্ঞান চর্চা করতে পারেননি। অন্যদিকে, শহরের মানুষ জ্ঞান চর্চার বিষয়ে গ্রামের মানুষের চেয়ে বেশি সচেতন বিধায় তারা সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। এতে করেই শহরের নারীরা তাদের অধিকার সমন্ধে সচেতন হন এবং এগিয়ে যান। ঠিক এভাবেই গ্রামীণ নারীরা পিছিয়ে যায় শহরের নারীদের তুলনায়।
যদিও এখন সময় পাল্টেছে। গ্রামীণ নারীরাও তাদের অধিকারের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া শুরু করেছেন। তবে সেটা শহরের নারীদের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। তাই, আমার পর্যবেক্ষণ বলে, গ্রামীণ নারীদের যেদিন মৌলিক অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত হবে সেদিন থেকে গ্রামীণ নারীরাও শহরের নারীদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাবে। এতে করে একদিকে যেমন দেশে নারীর ক্ষমতায়ন হবে ঠিক তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবেন একজন অধিকার সচেতন মা। আর এভাবেই একদিন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমান ভূমিকা পালন করবে এ দেশের নারীরা।