নারী অবমাননার নানা দিক
প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
সাজ্জাদ হোসেন
নারীর অবমাননা বা নির্যাতন পরিবার ও সমাজে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যৌতুকের জন্য, ফতোয়ার শিকার হয়ে, স্বামীর পরকীয়ার কারণে, ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের শিকার হয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদের অত্যাচার-নির্যাতনে এ দেশের অনেক অসহায় নারীর প্রাণ চলে গেছে, এখনো যাচ্ছে। কেউ কেউ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে, সন্তানসহ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মাহুতি দিয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে নারী সংগঠন, নারীবাদীরা এমনকি সরকারও স্বোচ্চার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপরন্তু মানিকগঞ্জ, সাভার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও বরিশালে চলন্ত বাসে এবং সিএনজিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এছাড়া শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বেশ কয়েকটি।
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্ব্ব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন। ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা কারিকুলাম নারীর প্রতিকূলে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্র আপসহীন না হলে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ না করলে সমাজের ভেতরে এই অবক্ষয় রুখে দাঁড়ানো যাবে না। পরিবারের দায়িত্ব নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা।
আমি দু'জন সম্পর্কে জানি, চলন্ত বাসে তারা অনায়াসেই নারীর শরীরে হাত রাখতে পারেন। এই হাত রাখার মধ্যে কী অপার আনন্দ খুঁজে পান, তা কেবল তারাই জানেন। আজকাল নারী-পুরুষ বাসে পাশাপাশি আসনে বসা নগরসংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল অংশ। দীর্ঘপথ পাশাপাশি বসতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে প্রেম-বন্ধুত্ব, এমনকি বিয়ে পর্যন্ত হয়েছে। অথচ এক শ্রেণির পুরুষের মানসিকতা এমন যে, 'নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য'। কোনো প্রবীণ লোক বেখেয়ালে বাসের মধ্যে কোনো তরুণীর শরীর স্পর্শ করলে ওই তরুণী হয়তো তাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখবে। অথবা ভাববে লোকটা উদাসীন। কিন্তু মধ্যবয়সি কোনো পুরুষ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটা করেন সেটা কী হিসেবে গণ্য হবে? কোনো কোনো তরুণী নিছক আত্মসম্মানের ভয়ে কিছু বলে না। যারা এসব করেন তাদের গণপিটুনি খাবার তার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধরনের পুরুষ কোনো নারীকে পাশে পেলেই স্বাভাবিক জীবন ও জগৎ থেকে তিনি মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তারা প্রবেশ করেন কোনো এক অলৌকিক-স্বাপ্নিক জগতে। যে জগতের অধিকর্তা, প্রতিভু তিনি নিজেই। এ যে কী আকর্ষণ, কী মোহ, তা হয়ত বা তারা অন্য কাউকে বলে বোঝাতে পারবেন না। আত্মসংযমের বিষয়টি এখানে উধাও। তাদের ভাষায়, ইদানীং বাসে চলাচলরত তরুণীরা নাকি বেশ উদার। তাদের শরীরে হাত দিলেও তারা তাকে কিছুই বলে না। সম্পর্কবিহীন বা অধিকারবিহীন কোনো নারীর শরীরে হাত দিলে তার তো মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা যে নারীর প্রতি অবমাননা অপরাধ এটা তারা বুঝতেই চান না। এই শ্রেণির পুরুষ সমাজে নেহাত কম নয়। এরা সুযোগ পেলেই নারীর ওপর চড়াও হন।
নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেবলই ভোগবাদী। তারা নারীকে সব সময় ভোগের বস্তু হিসেবেই গণ্য করে থাকে। অথচ নারী-পুরুষ উভয়েই পরিবার ও সমাজের জন্য অনিবার্য। পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগ, পরিকল্পনা, ত্যাগ ও সংযমের প্রয়োজন। একইভাবে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে নতুন সমাজ বিনির্মাণের জন্য উভয়েরই ভূমিকা ও অবদান সমভাবে প্রয়োজন। সে জন্য একজনকে উপেক্ষা করে বা বাদ দিয়ে কেবল পুরুষ কিংবা কেবল নারীর পক্ষে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়। তাই আমরা চাই, নারী-পুরুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সমঝোতামূলক সম্পর্ক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু আমাদের এ চাওয়ার সফল বাস্তবায়ন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কোথাও চোখে পড়ছে না। বরং প্রতিনিয়ত উল্টো ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে।
পান থেকে চুন খসলেই আমরা নারীকে অপবাদ দিই। কথায় কথায় নারীকে কুলটা চরিত্রহীন ব্যভিচারী বলে আখ্যা দিই। নারীর দোষের অন্ত নেই। অন্যদিকে, পুরুষরা শত অপরাধ করলেও তাদের চরিত্রে কোনো ধরনের কালিমা লিপ্ত হয় না। ভাবটা এমন যে পুরুষের 'চরিত্র' বলে কিছু নেই। এটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্ঠিভঙ্গিগত জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নারীর নয়, কেবলই পুরুষের। এটা যতদিন থাকবে ততদিন নারীর মুক্তি নেই, নারী স্বাধীনতার কথা বলে আমরা মুখে যতই ফেনা তুলি না কেন।
যারা এসব অপরাধ করে আসছে তাদের মানসিকতার কি বদল ঘটবে? মনে রাখতে হবে যেখানে পুরুষ রয়েছে সেখানেই নারী অনিরাপদ। এটা মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা। এই সমাজ নারীকে চিরকাল সেবাদাসী, যৌনদাসী কিংবা ভোগ্যপণ্য হিসেবেই বিচার ও বিবেচনা করে আসছে। সুতরাং, সুযোগ পেলেই যে পুরুষ নারীকে অবমাননা করবে, করবে যৌন নির্যাতন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নারী স্বাধীনতার নামে আমরা যা দেখছি এটা খোলস মাত্র। নারী সম্পর্কে সব পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই। এর প্রধান কারণ নারীকে আমরা কেবল নারীই ভাবি, মানুষ ভাবি না।
নারী অবমাননা কিংবা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর সমাধানে কেবল আইন করলেই চলবে না, সবাইকে দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানের দরকার। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্র সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আশার বিষয় হলো, বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী সবাই নারী। এমনকি স্পিকারও নারী। তৈরি পোশাক খাতের ৮০ ভাগ শ্রমিকই এখন নারী। বাংলাদেশের নারীদের সমান অধিকার দিয়েছে সংবিধান। সেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক আইনগুলোতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। নারীরা যেন সুবিচার পান, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে।
তবে সংবিধান নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দিলেও অশিক্ষা, দারিদ্র্য বাংলাদেশের নারীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। এ দেশের সহিংসতার শিকার একটি মেয়েকে থানার পুলিশ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সংকট মোকাবিলা করতে হয়। পদে পদে সবাই বোঝানোর চেষ্টা করে যেন মেয়েটাই দায়ী। নারী অবমাননা কিংবা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে মেয়েটিকে কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ নেই।
নারীর সবচেয়ে গস্নানিময় অপমানসূচক অধ্যায় হচ্ছে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া। এ দেশের নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার নানাভাবে হতে পারে। তবে এর দুটো দিক রয়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে যৌন নির্যাতন। যে নারীর শরীর যত আকর্ষণীয় ও লোভনীয় তার নির্যাতন ঝুঁকি তত বেশি। এ ধরনের নারী যখন রাস্তায় চলে তখন বখাটে ছেলেরা শরীরকে লক্ষ্য করে বাজে ইঙ্গিত করে। সুযোগ পেলে তাকে নির্যাতন ধর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নারীও যে মানুষ এটা তারা মুহূর্তে ভুলে যায়। এ ধরনের নির্যাতন ইদানীং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মক্ষেত্রেও হচ্ছে। এমনকি শিক্ষকরাও এ ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন, অবতীর্ণ হচ্ছেন ধর্ষণকারীর ভূমিকায়।
কোনো মানুষ শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক ও বিবেক-বিবেচনা বোধ তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তির মানেও বোঝে। মানুষের দুঃখ শোকে কাতর হন যিনি, সহমর্মিতা যার মধ্যে জাগ্রত হয় তিনি তো নারী অবমাননাকারী নির্যাতক বা হত্যাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। বিবেকবোধ ও মানবিকতা সব নারী-পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হলে নির্যাতন হত্যা কেন্দ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে। তবে তার আগে প্রয়োজন দেশব্যাপী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো, দারিদ্র্য বিমোচনে ও বেকারত্ব দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সবকিছু যদি সঠিক ও সমান্তরালভাবে চলে তবে সমাজ ও রাষ্ট্রও সঠিকভাবে চলবে। আর প্রতিদিন পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের ভয়াবহতা আমাদের প্রত্যক্ষ করা লাগবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। এটা যতদিন না হবে ততদিন পর্যন্ত নারী নির্যাতনের মাত্রা ও ভয়াবহতা কমবে না। আর এর জন্য আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, প্রতিবাদ সভা-পথসভার মাধ্যমে চিৎকার করেও কোনো লাভ হবে না।
নারী তো তার সামগ্রিকতা নিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। কিন্তু পুরুষকে তো তা গ্রহণ করার মানসিকতা, সাহস ও উদারতা অর্জন করতে হবে, হতে হবে উন্নত সাংস্কৃতিক ও রুচির অধিকারী। দায়িত্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজও এককভাবে পুরুষের। এ ব্যাপারে নারীরও করণীয় কম নয়। কারণ যিশুর ক্রুস যিশুকেই বহন করতে হয়েছে। স্বামী, অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনদের নারীর কর্তব্য কাজে উৎসাহ জোগাতে হবে। তাদের সফল উদ্যোগ ও চিন্তাকে স্বাগত জানিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। চরম বেকারত্বের এ দেশে, ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়ানো বাংলাদেশে, অতি উচ্চমূল্যের বাজারে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নারী স্বাধীনতা খোঁজা অর্থহীন। তবে চেষ্টা চালাতে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে দোষ কী। দিন না বাড়িয়ে সেই হাত।
সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধিসহ পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন এবং নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করলে কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হতে পারে, সে জন্য আমাদের নারীদের আরও দীর্ঘ পিচ্ছিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে।