আদিকাল থেকেই পরিবার ও সমাজে কন্যাশিশুরা অবহেলিত। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার নানা প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলো ভাঙতে হবে। সমাজের অসঙ্গতি ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ অবদান রেখেছেন। তাদের পথ অনুসরণ করে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব নেওয়া উচিত। কারণ কন্যাশিশুকে বাদ দিয়ে আমরা কখনও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না।
যে কোনো কল্যাণমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য নারী পুরুষের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু পুরুষরাই সব সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত নয়, নারীদের সুযোগ দিলে তারাও সবকিছু জয় করতে পারে। তারাও পুরুষের মতো সমাজকে আলোকিত করতে পারে। সেজন্য সব শিশুরই সমভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার দিতে হবে। তবে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য প্রাগৈতিহাসিক। সে ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি, এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েই নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সারা বিশ্বব্যাপী কন্যাশিশু দিবস প্রতি বছর পালন করা হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে পরিবার ছাড়াও সামাজিকভাবেও অনেক নারী ও কন্যাশিশু
নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।
বাল্যবিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানতম অন্তরায় এবং আমাদের সমাজ কন্যাশিশুদের বোঝা মনে করে। কন্যাশিশুদের পড়াশোনার পেছনে টাকা খরচ করতে চায় না। তারা মনে করে বিয়ে দিতে পারলে বোঝা দূর হয়ে গেল। তবে সময় অনেক বদলেছে। কন্যাশিশুরা এখন আর বোঝা নয়। বরং কন্যাশিশুরা হলো সর্বোত্তম বিনিয়োগ ও সমাজের আলোকবর্তিকা। কারণ তাদের মধ্যে থেকেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খুঁজে পাই। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বাবা মায়ের বেশি যত্ন নেয়। আসলে কন্যাশিশুদের পেছনে যদি সুশিক্ষিত করার জন্য ভালো বিনিয়োগ করা যায়, সেই একদিন বড় হয়ে আদর্শ ও মহীয়সী মায়ে পরিণত হয়। গাছকে যেমন ভালো পরিচর্যা করলে সে গাছ বড় হয়ে ফুল, ফল, কাঠ, ছায়া ও নির্মল পরিবেশ উপহার দেয়, ঠিক তেমনিভাবে একটি কন্যাশিশুর পেছনে বিনিয়োগ করলে পরিণত বয়সে সে একজন আলোকিত মায়ে পরিণত হয় এবং সে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নানাভাবে আলোকিত করে।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব নির্বিশেষে আমাদের সমাজে এমনকি নিজের পরিবারেও লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মেয়ে শিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ। ফলে, অনেকাংশেই দরিদ্রতার প্রথম শিকার হয় কন্যাশিশুরা। কিছু সামাজিক কথিত নীতির কারণে শিশুকাল থেকেই কন্যাশিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয়- যাতে করে তারা প্রতিবাদী হতে না শেখে। তাদের প্রতি করা বৈষম্যমূলক আচরণকে অন্যায় হিসেবে না দেখে বরং সহজাত ও সমঝোতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখানো হয়। যা পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার পথটিকে প্রশস্ত করতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন ধর্মে নারীর সমান অধিকারের কথা বলা হলেও সেটি নানা কুসংস্কারের অন্তরালে রয়ে গেছে। বর্তমান সরকার কন্যাশিশুর পরিপুষ্টতা ও লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অবদান রাখলেও সহিংসতার হার হ্রাস পায়নি বরং উন্নত ও আধুনিক সমাজে আজও বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, যৌতুকের মতো বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ভুক্তভোগী নারীরা বলেন, 'আমরা এগুলো থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই। তাই, আমাদের নারীদের নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের মাধ্যমে এসব সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। তবেই আজকের প্রতিপাদ্য সার্থক হবে ও সমাজে টেকসই উন্নয়ন হবে।'
বর্তমান আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজ ব্যবস্থায় আমরা কথায় কথায় বলি, 'সন্তান ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, মানুষ হওয়াটাই আসল কথা।' কিন্তু অনেকেই মৌখিকভাবে তা মানলেও মনে মনে ঠিকই চিন্তা করেন 'সন্তান হতে হবে ছেলে'। কন্যাসন্তান হওয়ার ক্ষেত্রে একজন নারীর কোনো ভূমিকাই নেই। এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি শিক্ষিত পুরুষটি জানার পরও মানসিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এ দায় চাপিয়ে দেন নারীর ওপরই। ফলে, কোনো অন্যায় না করে আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অভিযোগে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেন।
বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ কন্যাশিশু? আর বাংলাদেশে এখন কন্যাশিশু এক কোটি ৬০ লাখ- যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ কিন্তু এই কন্যাশিশুরা নানা দিক দিয়ে এখনো অবহেলিত তারা নিরাপত্তাহীনতা আর অপুষ্টির শিকার ঘরে বাইরে, সবখানে? দেশের বিভিন্ন জরিপ এবং গবেষণায় ১৫ থেকে ১৮-১৯ বছরের মেয়েরা গুরুত্ব পায় কিন্তু ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সি কন্যাশিশুরা কী অবস্থায় আছে তার চিত্র পরিসংখ্যানে স্পষ্ট নয় জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানীয় দেশগুলোর একটি বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সের মধ্যে ৫২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় সেভ দ্য চিল্ড্রেনের তথ্য অনুসারে, ১০ বছর বয়সি কন্যাশিশুদের অনেক বেশি বয়সি পুরুষদের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়।?
শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় শিশু আইন-১৯৭৪ যা যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে শিশু আইন-২০১১ রূপে প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯-এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এরপরেও শিশুর প্রতি বৈষম্য আর অধিকারের বিষয়টি আমরা ভুলে যাই।
আসলে শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি। শিক্ষা কন্যাশিশুর উন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ এবং শিশু মৃতু্যর হার কমানোর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং পস্ন্যান বাংলাদেশের এক যৌথ জরিপ মতে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা ২৬ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। নিরক্ষর নারীদের বেলায় এই সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। সরকার বিগত বছরগুলোতে ছাত্রী ও নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার জন্য নারীবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। যার ফলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলসমূহে ছাত্রী অনুপ্রবেশ এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
কন্যা শিশু ও নারীকে অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মধ্যে রেখে কখনোই একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে উঠতে পারে না। এই বাস্তবতায়, নারী ও কন্যাশিশুর শিক্ষার বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। সেটি শুরু করতে হবে কন্যাশিশুর জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে তাদের জন্য সমসুযোগ ও সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। আর এই মানবসম্পদ গড়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে কন্যাশিশুর জন্মলগ্ন থেকেই। মনে রাখতে হবে, আজকের কন্যাশিশু আগামী দিনের একজন সুশিক্ষিত মহীয়সী নারী ও আদর্শ মা এবং সেই আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করবে।