বিংশ শতাব্দীতে এসে 'নারীর অস্তিত্বের সংকট' বিষয়টি এক বিরাট আকার ধারণ করে চলেছে। বিষয়টি আমরা ছোট করে দেখলেও আধুনিক যুগে এসে এই বিষয়টি আস্তে আস্তে নারীকে তার অস্তিত্ব থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে নারীরা ঘরে ও বাইরে দুই জায়গায় বেশ এগিয়ে। পুরুষের সঙ্গে সমান তাল দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তবুও যেন আমরা নারীরা সফলতার উঁচু স্তরে এসে কোথাও নিজেকে পাই না। খুঁজতে গিয়ে দেখি আমরা অনেক আগে নিজের অস্তিত্বকে সফলতার অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। আমরা নারীরা ৫ বছর বয়স থেকে শুনে আসি- 'যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে'। সমাজ আমাদের তখন থেকে বুঝিয়ে দেয়- যদি তুমি রাঁধতে জানো তাহলে তোমাকে চুল বাঁধতেও জানতে হবে- সেটা যেভাবেই হোক। আর যদি তুমি না পার তাহলে তুমি স্বয়ংসম্পূর্ণ নও। আমাদের সমাজের মানুষ তখনই তোমাকে শোনাবে- 'মেয়ে হয়ে রাঁধতে পার না, তোমাকে কে বিয়ে করবে'? সেই কাজ না পারাটা বা না করতে চাওয়া এক সময় তোমার খুঁতে পরিণত হবে এটা। যার ফল হিসেবে সে নারী হীনম্মন্যতায় ভোগে এবং একটা সময় পর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে- কেন পারছি না? যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে নিজে নিজের অস্তিত্বকে খুব ভয়ংকরভাবে হারিয়ে ফেলে।
এছাড়াও আমরা অনেকে ঘরের কাজে পটু, আবার অনেকে বাইরের কাজে পটু। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক সমাজে এসে তুমি নারী তোমাকে ঘরে বাইরে উভয় জায়গায় হতে হবে নিখুঁত। আর তুমি যদি না পার তাহলে তোমাকে আমাদের আধুনিক সমাজ বুঝিয়ে দেবে তুমি একজন নারী হিসেবে ব্যর্থ। তবে শুধু সমাজ নয়, আমরা নিজেরাও নিজেদের অস্তিত্বের সংকটের জন্য দায়ী। এই ধর, তুমি তোমার স্বামী, দুইটা ফুটফুটে সন্তান নিয়ে বেশ ভালো সংসার করছেন। কিন্তু তারপরেও তোমার একটা সময় এসে মনে হবে, আমি সারা জীবন সংসার করে গেলাম, বাইরের জগৎ তো দেখলাম না। বাইরের সেই উঁচু ভবনে বসে চাকরি করতে পারলাম না, আসলে আমি জিরো। আমাকে দিয়ে সংসার ছাড়া আর কিছুই হবে না? অন্যরা তো সবই করতে পারে- আমি কেন পারি না। ঠিক সেই সময় সেই উঁচু ভবনে বসে যে নারী বিভিন্ন প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত সে হয়তো ভাবছে, আহ্! আমি সারাটা জীবন শুধু এই চাকরি চাকরিই করে গেলাম আমার মেয়েটার প্রথম হাসি দেখলাম না; তার স্কুলের প্রথম দিনের সঙ্গী হতে পারলাম না। এই যে এক আফসোস! দিন শেষে অনেক কিছু থাকার পরেও আমরা নারীরা নিজেকে কোথাও খুঁজে পাই না। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, আমি নারী হয়েও কেন আমি সব দিক থেকে পরিপূর্ণ না। এই যে একজন নারী হিসেবে নিজেকে খোঁজা নিজের অস্তিত্বের সংকটে ভোগা। ২০২৪ সালে এসেও নারীরা শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে অনেক বেশি অনিশ্চিতায় ভোগে। এই দেখেন অনেক নারীর মুখে ব্রণের দাগ, দেখতে বেশ স্বাস্থ্যবান বা হয়তো চাঁপা ফুলের ন্যায় গায়ের রং, মুখের বা শরীরের গঠন বার্বি ডলের মতো নিখুঁত না। তারা তাদের এই দিকগুলোকে মনে করেন তাদের খুঁত বা দুর্বলতা- যা তাদের সমাজে অনেক নিচুভাবে দেখা হয়। এছাড়া নিজেকে বারবার বলতে থাকে আমার মুখে এত ব্রন কেন, আমার শরীরের গঠন সুন্দর না, কেন আমার গায়ের রং চাঁপা? এগুলো থেকে তার নিজের মধ্যে জন্ম নেয় একটা আতঙ্ক আবার সমাজ, পরিবার ও নিজের সঙ্গীর কাছে হেয় হওয়ার ভয়। এই আতঙ্ক ভয় থেকে বের হতে বেছে নেয় কৃত্রিমভাবে নিজেকে সুন্দর করার চেষ্টা। এছাড়াও মেকাপে দিয়ে নিজের বার্ধক্য ঢাকার চেষ্টা। কিন্তু তোমার বয়স হবে তোমার শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়বে, তুমি সারাজীবন একভাবে সুন্দর থাকতে পারবে না, এইটাই বাস্তবতা। তবুও আমরা নারীরা কেন যেন এই আধুনিক সমাজে থেকেও এই বাস্তবতা মেনে নিতে সক্ষম হচ্ছি না। ঠিক সেই সময় আমরা নারীরা নিজের অস্তিত্বের সংকট অনুভব করি।
তুমি তো নারী, তোমার নিজ বলে কিছু নেই, তুমি সব সময় শুধু দিয়ে যাবে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা আমাদের এই ধরনের মানসিকতা মধ্যে দিয়ে নিয়ে আসছে সেই সৃষ্টি যুগ থেকে এখন পর্যন্ত। হাতে গোনা কিছুসংখ্যক ব্যতীত প্রায় সব নারী জানে না আমরা নিজেদের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি। সেই কিছু সংখ্যক নারী বোঝার পরেও চাইলেও বিষয়টা থেকে বের হতে পারছে না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে আমাদের নারীর অস্তিত্বকে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নিয়ে এসেছে। যার উদাহরণস্বরূপ প্রথমে বলতে হবে যেমন: তোমার সর্বোচ্চ শরীরিক সৌন্দর্য থাকতে হবে আর সেটা শুধু পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্য, তোমাকে নিয়ে মহলস্নাতে চলবে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ। তোমার চাকরি ক্ষেত্রে তোমার বসের মন জোগায় চলতে হবে বা সংসার জীবনে শ্বশুর বাড়িতে সবকিছুতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বৃথা প্রচেষ্টা তোমাকে আজীবন চালিয়ে যেতে হবে। এছাড়াও আমাদের নারী জাতির অন্যতম একটা রোগ পরশ্রীকাতরতা। উপরোক্ত উদাহরণগুলোর ফলস্বরূপ এই প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণের পর যখন হেরে যাই তখন নিজের ভেতরের আয়নায় আমি একজন নারী এই সত্ত্বাকে আর খুঁজে পায় না।
নারীর অস্তিত্বের সংকট বিষয়টি থেকে বের হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না হয় আমরা আমাদের সমাজের শুধু নারীকে পাব তার ভেতরের সেই সত্তাকে হারিয়ে ফেলব। তাই আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি সম্মান, তাদের একটু বোঝার চেষ্টা এবং তাদের মাঝে এইটা ঢুকিয়ে না দেওয়া তুমি নারী মানে তোমাকে সব পারতে হবে। তুমি যতটুকু পারো সেটাই যথেষ্ট। তুমি যেমন তেমনি ঠিক আছো। তুমি সংসার কর, তুমি সংসারে সুন্দর, সব সময় অন্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে সংসার করতে হবে না। তুমি তোমার মতো করে কর। তুমি চাকরি করছ সেখানেও তুমি সুন্দর। সব সময় বসের মন জোগায় চলতে হবে না। তোমাকে দিয়ে যতটুকু সম্ভব সেটুকু কর এর চেয়ে বেশি দরকার নেই। একজন পুরুষ যেমন অফিস করে, সে তো তার সন্তানের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারে না। তেমন তুমিও একজন চাকরিজীবী নারী, তুমি তোমার সন্তানের প্রথম হাসি নাইবা দেখলে। একজন পুরুষ মানুষ যেমন, তুমিও তেমন মানুষ। আমরা মানুষ মাত্র সব দিক থেকে নিখুঁত না। তোমার মধ্যে না হয় একটু খুঁত থাকল। একটু বার্ধক্যের ছাপ, একটু মোটা, চোখের নিচে না হয় একটু কাল দাগ। সব কাজ নাইবা পারলে তুমি যেমন তেমনই সুন্দর। আমরা নারী যে অবস্থায় আছি সে অবস্থা থেকে নিজেকে মেনে নিতে শিখি। তবে মেনে নেওয়ার জায়গাটা তৈরি করতে হবে আমাদের সমাজের, আমাদের পুরুষদের। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেখানে থেকে একটা নারী নিজের মতো করে কিছু করতে পারে- যাতে সে কোনো পিছুটান অনুভব না করে। অন্যের দাসত্ব থেকে বের হয়ে এসে অন্যজন কি ভাবল তা ভাবা বন্ধ করতে হবে। যা তাকে স্বস্তি দেয়- সেটা যেন করতে পারে। এজন্য আমাদের সবার উচিত সুন্দর মানসিকতা চর্চা করা। তুমি নারী, এটাই হোক তোমার শক্তি। তোমার অস্তিত্ব আছে বলেই মানবজাতি পৃথিবীতে এখনো বিরাজমান। তুমি অফিসে, সংসারে, পাকা চুলে, সুন্দর চোখ, মুখের ব্রন, চাঁপা গায়ের রং, লম্বা চুল বা তোমার কাজ করা শক্ত হাত সব মিলিয়ে তুমি একজন নারী। পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক ফুল। আর সেই ফুলকে আমরা নারী হিসেবে সম্বোধন করি।