'কোনোকালে একা হয়নি কো জয়ী, পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়ালক্ষ্ণী নারী'- কাজী নজরুল ইসলামের উক্তিটি পড়লেই বোঝা যায় এই মহাবিশ্বে যা কিছু মহীয়ান তার পেছনে নারীর রয়েছে কত-শত অবদান। বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃত। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে নারীসমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সক্রিয় ও কার্যকরী অবদান রেখে চলেছে। নারী ও পুরুষের সহাবস্থানের মাধ্যমেই উন্নয়নের চরম শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে উন্নত বিশ্ব।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসের একটি তালিকায় দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন- থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়ায় জিডিপিতে নারীর অবদান ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনস, জাপান, ইন্দোনেশিয়ায় এই হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশে এই হার অনেক কম। বাংলাদেশের জিডিপিতে নারীর অবদান মাত্র ১৯ শতাংশ- যা অন্য অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অন্যান্য খাতে চাকরির সুযোগ খুব সীমিত থাকায় আশির দশকে মূলত অদক্ষ নারী শ্রমিকরাই পোশাক খাতের হাল ধরেন। এর পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন যাবত পোশাক খাতে পুরুষ শ্রমিকের বিপরীতে গড়ে অন্তত দু'জন নারী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হতো। ফলে, এক সময় পোশাক খাতের মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী। যারা গ্রামাঞ্চল থেকে ঢাকা এসে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করতেন তারাই মূলত এই খাতে কাজ নিতেন। কিন্তু বর্তমানে এ চিত্রে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, পোশাক খাতে নিযুক্ত মোট শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা কমে ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অটোমেশন ও অন্যান্য খাতের তুলনায় মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা কম থাকার কারণেই মূলত এমন চিত্র লক্ষণীয় হচ্ছে। নারীদের এই বিমুখতার কারণ হিসেবে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, 'কম মজুরি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কঠিন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ও ভারী যন্ত্রপাতি চালানোর দক্ষতার অভাবে পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে।' এছাড়াও পর্যাপ্ত ছুটির অভাব, বোনাস আটকে রাখাসহ আরও বিভিন্ন সমস্যার কারণে আজ দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতে নারীদের বিমুখতা রয়েছে।
দেশের একটি উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক নারী প্রবাস জীবনযাপন করছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর তথ্যমতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাস পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের একটি উলেস্নখযোগ্য সংখ্যা আমাদের এই নারীসমাজ পুরুষের সঙ্গে সহাবস্থানের মাধ্যমে আমাদের দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে নারীসমাজ। অথচ নিরাপত্তাহীনতা, কম মজুরি ও পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ-সুবিধার কারণে নারীসমাজ এখন প্রবাসে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
দেশের কৃষিখাতে নারীদের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা ও অবদান উলেস্নখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ঈদুল আজহায় বেশিরভাগ গবাদি পশু এসেছে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে। দেশে প্রায় ১০ লাখ খামার রয়েছে, যার প্রায় ৬০ শতাংশ গ্রামীণ নারীরা পরিচালনা করেন। সারাবিশ্বে বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগলের ৯০ শতাংশই নারীরা পালন করে থাকেন। উলেস্নখ্য, বিশ্বের সব কৃষিপ্রধান দেশের মধ্যে বাংলাদেশেই কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে দ্রম্নত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণের হার হ্রাস পেয়েছে, কিন্তুত্ম সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে উলেস্নখযোগ্যভাবে। শুধু গবাদি পশুপালন খাত বিবেচনা করলেই নারীদের কৃষিতে বিশাল অবদানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এক সময় শুধু যোগাযোগ ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে এর ব্যবহারে এসেছে ভিন্নতা। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিকালেই মূলত মানুষ সামাজিক মাধ্যমগুলোর সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম ব্যবহার করেছে। মানুষ এখন এসব মাধ্যমকে উপার্জনের অন্যতম উপায়ে পরিণত করেছে। অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণে। সরাসরি কিংবা অনলাইন- দুই ধরনের ব্যবসাতেই নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার এ সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কাজে লাগিয়ে নারীরা ব্যবসামুখর হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস)-এর হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০ জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিল ২ লাখেরও বেশি। কিন্তু ২০০২-০৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার (বিবিসি বাংলা, ৩০ নভেম্বর, ২০২১)। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)-এর সদস্য সংখ্যা এখন ১৪ লাখ ৪৭ হাজার। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তাই রয়েছেন পাঁচ লাখের মতো। বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার শতকরা ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ নারী উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অগ্রগামী।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কর্তৃক উদ্যোক্তা চিহ্নতকরণ সংখ্যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৬ হাজার হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাংলাদেশে কুটির শিল্পেও নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাটজাত শিল্প, বাঁশ ও বেত শিল্প, মৃৎ শিল্প, তাঁত ও বস্ত্র শিল্প, হস্ত শিল্প, ক্ষুদ্র ইস্পাত ও প্রকৌশল শিল্প ইত্যাদি কুটির শিল্পে নারীর উলেস্নখযোগ্য অংশগ্রহণ রয়েছে। মাটির মূর্তি, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, কলসি, পুতুলসহ বিভিন্ন খেলনা জাতীয় দ্রব্য তৈরি, চুন ও ঠোঙা তৈরি, বাঁশ ও বেতের কাজ, তাঁত বোনা, জাল বোনা, মাদুর বোনা, কাগজের ফুল ও কলম তৈরি শিল্পে নারীরা উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। এর পাশাপাশি, নকশিকাঁথা, কাঁচ, মোম ও শোলা দিয়ে বিভিন্ন শৌখিন পণ্য তৈরি, বস্নক বাটিক ও টাই ডাই শিল্পেও নারীদের ভূমিকা প্রায় একচ্ছত্র। মূলত নব্বইয়ের দশক থেকে বুটিক শিল্পের নতুন জাগরণে কুটির শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
নারী শুধু তৈরি পোশাক শিল্প, প্রবাসী আয়, কৃষিকাজ, উদ্যোক্তা ও কুটির শিল্পেই নয়, তারা দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন জায়গায় সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে করপোরেট সেক্টরেও এখন নারীদের ভূমিকা উলেস্নখযোগ্য। দেশের ওষুধ শিল্পে পুরুষের পাশাপাশি নারীও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। ১৯৯২-৯৩ সালে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৫১টি দৈনিকে পুরুষের বিপরীতে ১.৪ শতাংশ নারী সাংবাদিক রয়েছেন। কিন্তুত্ম বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ বহুগুণে বেড়েছে। এখন প্রায় সমানসংখ্যক নারী ও পুরুষ সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন। তাছাড়া নারী শিক্ষাক্ষেত্র, ওষুধ শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, চা শিল্প, প্রশাসন খাত, সামরিক ও বেসামরিক খাত, স্বাস্থ্য খাত, প্রযুক্তিগত খাত, ব্যাংক ও এনজিওতে তাদের উলেস্নখযোগ্য অংশগ্রহণ ও অবদানের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখছে।
দেশের অর্থনীতিতে নারী সমাজের সর্বব্যাপী অবদানের পরেও প্রতি বছর উলেস্নখযোগ্য হারে নারী শ্রমিক সংখ্যা কমছে- যা আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য এক গভীর সংকেত?ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৪ এর ২য় কোয়ার্টার (এপ্রিল-জুন) অনুযায়ী, কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীতে নারীর সংখ্যা ক্রমশসমান। শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ (বার্ষিক) অনুযায়ী, কর্মে নিয়োজিত মোট ৭০ দশমিক ৪৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী মাত্র ২৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। দুঃখের ব্যাপার হলো শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৪ ২য় কোয়ার্টারে পুরুষের কর্মে নিয়োজিত থাকার হার বাড়লেও নারীর হার নেমেছে ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশে। তাছাড়া নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারও উলেস্নখযোগ্য হারে কমছে। শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৪ ২য় কোয়ার্টারে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৩৯ দশমিক ২০ শতাংশ- যা ২০২২ সালের বার্ষিক জরিপ অনুযায়ী ছিল ৪২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এখন প্রশ্ন হলো, নারীর কর্মে নিয়োজিত থাকার হার ও শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার কমার কারণগুলো কী? কথায় আছে, যে রাধে সে চুলও বাঁধে। নারী ঘরের সঙ্গে ঘরের বাইরেও সমানতালে কাজ করেন। কিন্তুত্ম আজও বাইরে কাজ করার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি নারীর। মজুরি বৈষম্য, অধিক কর্মঘণ্টা, কর্মক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার, পর্যাপ্ত ছুটির অভাব, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদিসহ আরও বিভিন্ন কারণে নারী আজ শ্রমবিমুখ।
শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। নারী-পুরুষের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম যদি সমান হয় সেখানে তাহলে মজুরি বৈষম্য থাকতে পারে না। মজুরি বৈষম্য দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ও সেটার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী কোনোরূপ হেনস্তার শিকার হলে হেনস্তাকারীকে দ্রম্নত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টার সংস্কার প্রয়োজন। নারীশিক্ষা অবশ্যই অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গত কারণেই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, 'তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দিব।' সেজন্য আমাদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তনের প্রয়োজন বেশি।