দিনে দিনে আমাদের দেশের নারীদের প্রভূত উন্নতি হচ্ছে। সামাজিক বাধা পেরিয়ে সব ধরনের কর্মকান্ডে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। পুরুষের পাশাপাশি আজ দেশের সব সেক্টরে নারীদের জয় জয়কার। বর্তমান সরকার নারী-পুরুষের সমতা আনয়নে কাজ করে চলেছে। সরকারের বাস্তবমুখী নানা পদক্ষেপের কারণে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে নারীরা অবদান রাখছেন। নারীরা এখন বিচরণ করছেন দেশের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত। আমরা দাবি করি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৃত্ত ভেঙে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলে থাকেন, দেশে এখন নারী-পুরুষের সমতা রয়েছে। আসলে কী তাই? বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনো দেশের অধিকাংশ নারী নিজের ঘরেই অবহেলিত। এখনো সমতার ছিটেফোঁটাও আসেনি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে নারীদের অবস্থান এখনো সেই প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থাতেই রয়ে গেছে। কর্মজীবী পুরুষদের থেকে নারীদের প্রায় দ্বিগুণ কাজ করতে হয়। কর্মজীবী পুরুষ অফিসে কাজ করে বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সামলিয়ে নীড়ে ফেরার পর ঘরের কাজে অংশগ্রহণ করেন খুবই কম। অন্যদিকে, অফিস বা কারখানায় কাজ শেষ করে ঘরে ফেরার পরও নারীর ফুরসত নেই। পরিবারের রান্না করা থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক সব কাজও করতে হয় তাকেই। ফলে সৃষ্টিশীল কর্মজীবী নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা নিয়ে টিকে থাকা তাই পুরুষের চেয়ে অনেক অনেক গুণ কঠিন।
গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা যায়, একজন কর্মজীবী পুরুষের চেয়ে একজন কর্মজীবী নারী বাসায় কমপক্ষে দ্বিগুণ কাজ করেন। বাইরের ঝামেলা বা অফিসের কাজ সামলিয়ে বাসায় ফিরে ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী নারী রান্নাবান্না করেন। আর মাত্র ২.৫ শতাংশ পুরুষ এ কাজটি করে থাকেন। বাসায় পরিবারের সদস্যদের কাপড় ধোয়া ৮৯ শতাংশ নারী আর এ কাজটি করেন মাত্র ১১ শতাংশ পুরুষ। পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্য ও শিশুদের দেখাশোনা ও লালনপালন করেন ৫৩ শতাংশ নারী। সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ মাত্র ২১ শতাংশ। এ ছাড়া ২৬ শতাংশ কর্মজীবী নারী চাকরির পাশাপাশি সংসারের জন্য কেনাকাটাও করে থাকেন। এসব কাজের বাইরেও সংসারের অন্য কাজগুলোতে কর্মজীবী নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় অনেক। ফলে কর্মজীবী নারীরা পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের 'নারী, ব্যবসা ও আইন শীর্ষক' এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের মাত্র ছয়টি দেশে নারী-পুরুষের সমতা আছে। বাকি দেশগুলোতে রয়েছে নারীর প্রতি বৈষম্য। নারী বৈষম্যের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ৪৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ- যা একেবারে নিচের দিকে। প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করতে বিশ্বব্যাংক গত ১০ বছর ধরে বিশ্বের ১৮৭টি দেশে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একই স্কোর অর্থাৎ ৪৯ দশমিক ৩৮ শতাংশতেই অবস্থান করছে। যেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশ ২০১২ সালের অবস্থান থেকে অনেকটা উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে স্থিতিশীল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, একজন কর্মজীবী নারী একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কাজ করেন। কর্মজীবী নারী নিজের পরিবারে বা বাড়িতে যে কাজগুলো করেন তার কোনো আর্থিক মূল্যায়ন হয় না। ফলে নারীদের পারিবারিক কাজের গুরুত্ব যেন অদৃশ্যই থেকে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপে কর্মজীবী নারীর ঘরের কাজকে দ্বিগুণ বোঝা বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। তবে পরিবারে বা বাইরে কোথাও তার কাজের মূল্যায়ন না হওয়ায় তারা থেকে যাচ্ছেন পাদপ্রদীপের অন্ধকারে।
গবেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সরকার নানাবিদ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে নারীর উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্র অনেক দূর এগিয়েছে। তবে, এখনো আমাদের দেশের পুরুষরা নারীর ক্ষমতায়নকে ভালোভাবে গ্রহণ করার জন্য বিন্দু পরিমাণ প্রস্তুত নয়। আমাদের প্রচলিত সমাজ নারীদের ওপর অতিরিক্ত শ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ায় নারীরা এই ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীরা আজ সমাজের সর্বস্তরে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেও নিজের পরিবারে তাদের অবস্থান মোটেও বদলাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে গত দুই দশকে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। দুই দশক আগেও যে কাজ পুরুষের বলে মনে করা হতো সে কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে অংশ নিচ্ছে। অর্থাৎ যে কাজটি পুরুষের কাজ বলে বিবেচিত হতো তা নারী-পুরুষ সমানভাবে যেন ভাগ করে নিয়েছে। অপরদিকে, যে কাজ নারীর কাজ বলে বিবেচিত হতো এখনো তা নারীর কাজই রয়ে গেছে। সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।
দেশের শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়লেও তাদের নিস্তার নেই। ঘরের কাজ নিয়মিতই করতে হচ্ছে তাকে। এক কথায়, ঘরে-বাইরে নারীদের রোবটের মতো কাজ করতে হচ্ছে। বেশির ভাগ পুরুষ তার কর্মজীবী স্ত্রীর মতোই অফিস করে ঘরে ফিরে পরিবারের কাজে স্ত্রীদের সহায়তা করেন না। কিন্তু নারী অফিসে কাজ করে যতই ক্লান্ত বা বিধ্বস্ত থাকেন না কেন ঘরে ফিরেই তাকে সন্তান সামলানো, ঘরে প্রবীণ কেউ থাকলে তার দেখাশোনা উপরন্তু স্বামীর সেবায় তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়নকে গ্রহণ করার জন্য পুরুষদের প্রস্তুত করে তোলা। নারীর পাশাপাশি পুরুষদের ঘরের কাজে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে হলে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষার প্রয়োজন। সে শিক্ষা শুরু করতে হবে বিদ্যালয় ও ঘর থেকে। একটি পরিবারের শিশু যদি তার মায়ের সঙ্গে পরিবারের ছোটখাটো কাজে অংশ নেয় তবে সেই শিশুটি বড় হয়ে নিজের ঘরের কাজে অংশ নেবে। সে কাজকে তখন সে নারীদের কাজ বলে মনে করবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীর এ অবস্থান পরিবর্তনে প্রথমেই প্রয়োজন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। আমরা সাধারণত বলে থাকি, একটি পরিবার তখনই সুখী হয় যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি আন্তরিক থাকেন। এর জন্য নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও পরিবারের সব কাজে-কর্মে সমান দায়িত্ব নিতে হবে। একজন নারী বাইরের দিক সামলিয়ে ঘরেও অমানসিক শ্রম দিয়ে থাকেন। এটি অত্যন্ত অমানবিক এবং নারীর প্রতি পুরুষের অবহেলা। নারীরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি প্রায় সমান কাজ করে চললেও বাসায় এসে পুরুষতান্ত্রিক বাধা কাটাতে পারছেন না। এই পুরুষতান্ত্রিক বাধা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠতে পারলেই নারী-পুরুষের সমতা আনয়ন সম্ভব।