মন সুন্দর কি না?

প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মাকসুদা আক্তার
প্রাণ না থাকলে যেমন প্রাণী হয় না, তেমন মন না থাকলে মানুষ হয় না। মানবিক প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ একজন মানুষকে করে মন থেকে সুন্দর। অর্থাৎ আপনি কতটা সুন্দর তা নির্ভর করে আপনার মনের ওপর, গায়ের রঙের ওপর নয়। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও প্রায় ৮৭ শতাংশ মানুষই মনে করে ফর্সা বা সাদা মানেই সুন্দর। এই সৌন্দর্য ভাবনা কালে কালে প্রবাহিত হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সব বয়সের, সব দেশের নারী-পুরুষ বর্ণভেদের নিষ্ঠুর নিয়ম দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছে নীরবে। যদিও নারীকেই সবচেয়ে বেশি এই বর্ণভেদের শিকার হতে হয়। গায়ের রং তাকে করে পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ গায়ের বর্ণ কখনোই একজন মানুষের সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি হতে পারে না। আদিকাল থেকেই সৌন্দর্যের ধারণা আবর্তিত হচ্ছে গায়ের রংকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আসলেই কী সাদা ও কালো গায়ের রং দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে একজন ব্যক্তির অবস্থান? উত্তর হবে, হঁ্যা! আপনার গায়ের রংই আপনাকে দেবে আলাদা সম্মান ও গুরুত্ব। বিষয়টা শুনতে উদ্ভট মনে হলেও আমাদের সমাজে আদি থেকেই এই কুৎসিত নিয়মটি চলে আসছে। বলা হয়ে থাকে 'আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী' বর্তমান মূর্খ জনসমাজে এই প্রবাদটি ভিন্ন এক অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। দর্শন সুন্দর হলেই তবে গুণের প্রসঙ্গ আসবে কিন্তু এখানে দর্শন হতে হবে ফরসা, চকচকে শরীর। বিয়ের পাত্রী দেখার ক্ষেত্রে অচলায়তন সমাজে এই রেওয়াজটি অনেক বেশি প্রচলিত। পাত্রী দেখতে গেলে প্রথমেই দেখা হয় তার গায়ের রং কেমন। যখনই বলা হয় একটু চাপা/কালো তখনই নানা অজুহাতে ভেঙে যাচ্ছে বিয়ে। ফলে পাত্রী দায়গ্রস্ত বাবা-মাকে দিতে হচ্ছে উচ্চহারে যৌতুক। এখনো কালো মেয়ে জন্মালে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটার আগে আত্মীয়স্বজনের কালো মুখ দেখতে হয়। মেয়ে জন্মের পরই যেন তার বর খোঁজার চিন্তা তাদের অস্থির করে তোলে; আর ছেলের বাড়ির তো কথাই নেই; বউ দরকার আমার সুন্দরী। আর সুন্দরী মানে ফরসা, সাদা। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যখন জীবনের সব রং ফুরিয়ে যায় তখন আর এসব রং তাদের ভাবায় না।? আমি বলছি না আপনি অসুন্দর মেয়ে বিয়ে করুন, আপনার মনটাকে শুধু সুন্দর করুন। ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে কত মেয়ে মন থেকে হয়ে পড়ে জরাগ্রস্ত। তাদের ছোট থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয় সৌন্দর্যের সেই এক সংজ্ঞা। ফলে ছোট থেকেই গায়ের রং ফরসা করার জন্য নানা ধরনের কসরত করতে হয় তাদের। কখনো প্রাকৃতিকভাবে এটা-ওটা মেখে, আবার কখনো বিভিন্ন রং ফর্সাকারী ক্রিম মেখে নিজেকে ফর্সা হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই চোখে পড়ে। বর্তমান সমাজে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফোনেও বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গৌরবর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একবার ভেবে দেখুন তো আপনি মানুষ হয়ে জন্মেছেন এটাই তো আপনার সৌন্দর্যের মাপকাঠি হওয়া উচিত। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে আপনাকে কেন সাদা বা কালো দিয়ে নির্ধারণ করতে হবে কারও সৌন্দর্য! মানুষ যেমনই হোক কালো বা সাদা, মোটা বা চিকন, লম্বা বা খাটো সব অবস্থানেই সে সুন্দর। পৃথিবীর অনেক দেশে শুধু গায়ের রঙের কারণে মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে একে অন্যের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করার জন্য। কিন্তু কর্তৃত্ব বিস্তারের মানসিকতা থেকে নয়, মানবিক দিক থেকে হওয়া উচিত এই লড়াই। কালো আর সাদা বাইরের রং শুধু ভেতরে তো সবারই এক রং। এই ভাবনায় উজ্জীবিত হতে না পারলে বর্ণভেদ দূর করা কখনোই সম্ভব নয়। বেঁচে থাকতে হলে দরকার সঠিক বুদ্ধি, ইতিবাচক চিন্তা এবং একটা সুন্দর মন, ফর্সা চেহারা নয় এ কথাটা আমরা অনেকেই ভুলে যাই। সময় এসেছে সমাজের এই অচলায়তনকে ভেঙে নতুন নিয়মে পথ চলার। কালো হোক বা ফর্সা সবাই সুন্দর!